ব্যবসা ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিভাগ পূর্বকাল থেকেই চুয়াডাঙ্গা যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল। কলকাতা সন্নিকটে হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্রুত প্রসার ঘটে। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে তাঁতের কাপড়, নীল, গুড়, নৌকা ও পিতলের বাসন-কোসন তৈরির জন্য চুয়াডাঙ্গা অঞ্চল বিখ্যাত ছিল। যদিও ব্রিটিশ বাণিজ্য নীতির প্রতিকূলতার ফলে এইসব শিল্পের অনেকগুলো বিশেষত বস্ত্র ব্যবসা আস্তে আস্তে ধ্বংস হতে থাকে।
চুয়াডাঙ্গা জেলার ভারি শিল্প বলতে কেরু এ্যান্ড কোম্পানির শিল্প কমপ্লেক্সকেই বোঝায়। ১৯৩৮ সালে পূর্ব-বাংলার আখ সমৃদ্ধ এলাকা দর্শনায় রবাট রাসেল কেরু দৈনিক ১০০০ টন আখ মাড়াই ও ৪০০০ এল.পি.জি স্পিরিট তৈরির ক্ষমতা সম্বলিত এই চিনিকল ও ডিস্টিলারিটি স্থাপন করেন। তখন শুধু যন্ত্রপাতি কিনতেই খরচ হয়েছিল ৩৪ লাখ টাকা । ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর এটি জাতীয়করণ করে কেরু এ্যান্ড কোং (বাংলাদেশ) লিঃ নামে অভিহিত করা হয় । বর্তমানে এটি বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থার একটি প্রতিষ্ঠান এবং এর অধীনে রয়েছে চারটি প্রতিষ্ঠান- চিনিকল, চোলাই (ডিস্ট্রিলারি), ঔষধ কারখানা ও একটি কৃষি খামার।
চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা, দর্শনা প্রভৃতি স্থান অতীতকাল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। তন্মধ্যে পাটের আড়তের জন্য আলমডাঙ্গা, ডাল ব্যবসার আড়তদারী বাজারের জন্য আলমডাঙ্গা ও মুন্সীগঞ্জ এবং সর্বোপরি কাপড়ের আড়তদারী ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে চুয়াডাঙ্গা ও আলমডাঙ্গা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আলমডাঙ্গা তাঁত শিল্পের প্রধান কেন্দ্রগুলির অন্যতম। এসব এলাকার তৈরি কাপড়ের ধুতি, শাড়ী, গামছা, লুঙ্গি, তোয়ালে ও বিছানার চাদর উল্লেখযোগ্য। এসব কাপড় বিক্রির জন্য এখানে একটি বড় বাজার আছে। হাজার হাজার পরিবার এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এখানকার তাঁতিরা যথেষ্ট দক্ষ। উন্নতমানের শাড়ী, লুঙ্গি তৈরিতে এদের সুনাম আছে। বর্তমানে চুয়াডাঙ্গায় স্থাপিত তাল্লু ন্পিনিং মিলস বিশেষভাবে পরিচিত।
আধুনিককালে চুয়াডাঙ্গা জেলার ব্যবসা-বাণিজ্য আগের তুলনায় সম্প্রসারিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেশ কিছু মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান। কৃষিও শিল্পে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে এবং সেই সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতর হওয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটেছে। তবে লক্ষণীয় এই যে, আগের মতো কৃষিপণ্যই ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান উপকরণ। ফলে শিল্পজাত ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও এবং শহর অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত আধুনিক বিপণী ব্যবস্থা চালু চেষ্টা থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্যের সিংহভাগই কৃষিজাত ভোগ্যপণ্যের উপর নির্ভরশীল।বর্তমানে চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৪টি মাঝারি শিল্প ৭৪৬টি ক্ষুদ্র শিল্প এবং ৪ হাজার ৮৬২ টি কুটির শিল্প রয়েছে।
সম্প্রতিকালে চুয়াডাঙ্গা জেলায় ক্ষুদ্র শিল্পের যথেষ্ট সম্প্রসারণ ঘটেছে। এখানে অসংখ্য ধান থেকে চাল তৈরির মিল গড়ে উঠেছে। রয়েছে বেশ কিছু স-মিল। ছোট আকারে কিছু বিড়ি শিল্পও লক্ষ্য করা যায়। বেকারি শিল্প রয়েছে বেশ কয়েকটি। চুয়াডাঙ্গার বঙ্গজ বিস্কুট ফ্যাক্টরি সারাদেশে বিশেষভাবে পরিচিত।
চুয়াডাঙ্গার ব্যবসা বাণিজ্য বলতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের আড়ৎদারিকেই বোঝায়। চুয়াডাঙ্গা জেলা পানের জন্য সারাদেশে পরিচিত। এ জেলায় উৎপাদিত পান প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলায় ও বিদেশে রপ্তানি করা হয়। চুয়াডাঙ্গা জেলার খেজুরের গুড় সারাদেশে বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। এ জেলায় প্রচুর খেজুর গাছ জন্মে। এ অঞ্চলের খেজুর গাছের রস খুব মিষ্টি ও সুস্বাদু। এর আহরিত রস দ্বারা উৎপাদিত গুড় সুদুর অতীত থেকে এখন পর্যন্ত বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দেশে ও বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।
ইদানিং চুয়াডাঙ্গা জেলায় পোলট্রি শিল্প বেশ বিস্তার লাভ করেছে। এদের মধ্যে রাফিদ পোলট্রি এন্ড হ্যাচারী লিঃ অন্যতম। যারউৎপাদিত পণ্য দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানী হচ্ছে। এ ছাড়াও এজেলায় ব্যক্তি উদ্যোগে অনেক পোলট্রি খামার গড়ে উঠেছে।
এ জেলার সীমান্ত দর্শনায় চেকপোস্ট থাকায় সেখানে বেশ কিছু ক্লিয়ারিং-ফরওয়াডিং ব্যবসার অফিসও গড়ে উঠেছে। ফলে আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার প্রসার লাভ করেছে এবং অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে। এবং বর্তমানে এ জেলায় প্রস্তাবিত আরেকটি স্থলবন্দর স্থাপনের কাজ প্রক্রিয়াধীন।
জেলার শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা:
শিল্পের ধরন |
সংখ্যা |
মাঝারি শিল্প |
৪টি |
ক্ষুদ্র শিল্প |
৭৪৬টি |
কুটির শিল্প |
৪ হাজার ৮৬২ টি |
চুয়াডাঙ্গা জেলা ভুট্টা, তামাক ও পানে, খেজুরের গুড় এর জন্য বিখ্যাত। এ জেলায় বাণিজ্যিকভাবে ফুল এবং আম উৎপাদন করে থাকে। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশনটি চুয়াডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন।
চুয়াডাঙ্গার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার নথিপত্রে দেখা গেছে, ১৯৮৭ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা অনুয়ায়ী চুয়াডাঙ্গা জেলায় সর্বমোট মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ১১০০ জন। ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৫ সালে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫০০। এরপর ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালে তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সর্বশেষ নাম ওঠে প্রায় ১৮০০ জনের।
সমুদ্র থেকে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
চুয়াডাঙ্গা: স্বাধীনতা যুদ্ধের সুতিকাগার বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানী চুয়াডাঙ্গা। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে চুয়াডাঙ্গা শত্রুমুক্ত করেন বাংলার মুক্তিসেনারা।
১৮৬২ সালে ১৫ নভেম্বর চুয়াডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন চালু হয়। চুয়াডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন চালু হলে ১৮৬২ সালে মহকুমা সদর দপ্তর দামুড়হুদা থেকে চুয়াডাঙ্গায় স্থান্তরীত হয়। যার ফলে চুয়াডাঙ্গা তখন নদীয়া জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ মহকুমা এবং বড় ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।