জগন্নাথপুর রাজা বিজয় মাণিক্যের রাজ্য বলে ঘোষিত। জগন্নাথপুরের পাণ্ডুয়া থেকে রাজা বিজয় মাণিক্য সেই সময় নিজ নামের সঙ্গে দুই স্ত্রীর নাম যুক্ত করে ১১৯১ খ্রিষ্টাব্দে সিক্কা মুদ্রা প্রকাশ করেছিলেন। এই সিক্কা মুদ্রাই রাজা বিজয় মাণিক্যের রাজ্যের প্রমাণ, যা কুবাজপুর গ্রামের মদনমোহন চৌধুরীর পরিবারদের কাছে সংরক্ষিত আছে।
জগন্নাথপুর এককালে বর্তমান ভৌগোলিক সীমানার চেয়ে আরও বড় ছিল। দ্বাদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত জগন্নাথপুর রাজ্য লাউড়ের শাখা-রাজ্য ছিল এবং বংশানুক্রমে লাউড়ের নৃপতিগণ কর্তৃক শাসিত হত। দিল্লি সম্রাটদের রেকর্ডে জগন্নাথপুর রাজ্য লাউড়ের এজমালি সম্পদ হিসেবে বিবেচিত এবং শ্রীহট্টের ইতিহাসে বর্ণিত আছে যে, উক্ত লাউড় রাজ্য সর্বদা মোগল সম্রাটদের কাছে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে গণ্য ছিল। তাই জগন্নাথপুর রাজ্যের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে প্রাচীন লাউড় রাজ্যের কথা চলে আসে, কারণ এর পত্তনস্থলই হচ্ছে প্রাচীন লাউড়। প্রাচীন লাউড়ের পত্তন সম্পর্ক মূলত প্রাচীন কামরূপ। বৌদ্ধ পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ (৬০২–৬৬৪) কামরূপ রাজার আমন্ত্রণে ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে এদেশে ভ্রমণে এলে শ্রীহট্টকে কামরূপ রাজ্যের অংশ বলে উল্লেখ করেন। উল্লেখ্য, বিভিন্ন বৌদ্ধগ্রন্থেও সিলেটকে সমুদ্র নিকটবর্তী বলা হয়েছে। এছাড়া নিধনপুরে প্রাপ্ত তাম্রলিপিগুলোও তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
খ্রিস্টপূর্ব ত্রিশ শতাব্দীতে ভগদত্ত নামের জনৈক নৃপতি কামরূপে রাজত্ব করতেন। তার রাজ্য বিবরণে বলা হয় যে, তৎকালে লাউড়ের পাহাড়ে ভগদত্ত রাজার একটি শাখা-রাজধানী ছিল। তিনি যখনই এদেশে আসতেন সেখানেই অবস্থান করতেন এবং লাউড় থেকে দিনারপুর পর্যন্ত নৌকাযোগে ভ্রমণ করতেন। উপরে উল্লেখিত ঐতিহাসিক আলোচনায় প্রমাণ হয় যে, প্রাচীন শ্রীহট্টের নিম্নাঞ্চল তখনকার যুগে গভীর পানির নিচে নিমজ্জিত ছিল। উল্লেখ্য, মহাভারত গ্রন্থের সভাপর্বে লিখিত: “ভিম পণ্ডু বঙ্গদেশ জয় করিয়া তাম্রলিপ্ত এবং সাগরকুলবাসী ম্লেচ্ছদিগকে জয় করেন।” এই তথ্যের ভিত্তিতে ভূতত্ত্ব বিষয়ের পণ্ডিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বঙ্গে প্রবেশাধিকার গ্রন্থে মহাভারতে উল্লেখিত বঙ্গ উত্তর-পূর্ব বঙ্গদেশ অর্থে প্রাচীন লাউড় অঞ্চল বলেছেন। সুতরাং উল্লেখিত লাউড় শ্রীহট্টই নয়, বঙ্গ হতেও প্রাচীন। পুরাতাত্ত্বিক রমেশচন্দ্র দত্তের মতে ব্রহ্মপুত্রের তীরবর্তী কামরূপ রাজ্যের বিস্তৃতি প্রায় ২,০০০ মাইল।
আসাম, মণিপুর, ময়মনসিংহ, শ্রীহট্ট, কাছাড় প্রভৃতি নিয়ে কামরূপ বিস্তৃত ছিল। সুতরাং, এদিক থেকে বিবেচনায় প্রতিপাদ হয় যে নৃপতি ভগদত্তের লাউড় রাজ্য মহাভারতকালের চেয়েও প্রাচীন। মহাকাব্য মহাভারতে প্রমাণ মেলে যে রাজা ভগদত্ত যুদ্ধে মহাবীর অর্জুন কর্তৃক নিহত হন। ভগদত্ত রাজার পরে তার পুত্রগণের মধ্যে ১৯ জন নৃপতি পর্যায়ক্রমে কামরূপ তথা লাউড়ে রাজত্ব করেন। ভাটেরায় প্রাপ্ত তাম্রফলকে বর্মান, ঈশানদেব তাদেরই বংশধর বলে ইতিহাসবেত্তাগণ উল্লেখ করেছেন। এই রাজাগণ চন্দ্রবংশীয় বলে খ্যাত। উক্ত ১৯ জন নৃপতির অনেকদিন পরে প্রাচীন লাউড় রাজ্যে নৃপতি বিজয় মাণিক্য আবির্ভূত হন। ১১৯১ খ্রিষ্টাব্দে বিজয় মাণিক্য জগন্নাথপুর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং ছিক্কা মুদ্রার প্রচার করেন।
সুনামগঞ্জ জেলা লোক সংগীত এর জন্য বিখ্যাত। বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের জন্ম সুনামগঞ্জে, হাসন রাজা, রাধরমন দত্ত, দূরবীন শাহ, ক্বারি আমির উদ্দিন এবং আরো অনেক সনামধন্য বাউল এর জন্ম সুনামগঞ্জে হয়েছে। সুনামগঞ্জে অনেক দর্শনীয় জায়গা রয়েছে যেমন, নীলাদ্রি লেক, টাংগুয়ার হাওর, শিমুল বাগান, যাদুখুটা নদী ইত্যাদি।
স্বাধীনতাযুদ্ধে সুনামগঞ্জ জেলা ছিল জাতীয়ভাবে বিভক্ত সেক্টর-৫ এর অন্তর্গত। ৫নং সেক্টরের বিস্তৃতি মূলত সুনামগঞ্জ জেলা বা সাবেক সুনামগঞ্জ মহকুমাব্যাপী। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল মীর শওকত আলী। সুনামগঞ্জ জেলা স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ মুক্তিযুদ্ধের সূচনা থেকে শেষ পর্যন্ত গৌরবজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে।
সুনামগঞ্জ জেলা আয়তন: ৩,৬৬৯.৫৮ বর্গ কিমি। অবস্থান: ২৪°৩৪´ থেকে ২৫°১২´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯০°৫৬´ থেকে ৯১°৪৯´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ।
১৭৭৪ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সময় জর্জ ইংলিশ ব্যবসার করার জন্যে স্ব-পরিবারে এখানে অবস্থান করে চুনা পাথরের ব্যবসার আরো প্রাতিষ্টানিক রূপ দেন। সে সময়ে ছাতক চুনশিল্পে সারা বিশ্বে পরিচিতি ও খ্যাতি অর্জন করে।
ভাষা
সুনামগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে প্রাচীন চর্যাপদের ভাষার মিল পরিলক্ষিত হয়। অন্য অঞ্চলের সঙ্গেও এমন দাবী যুক্তিযুক্ত। অন্তত বিশেষজ্ঞদের অভিমত এমনটিই। পণ্ডিত সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, চর্যাপদের ভাষা পশ্চিমবঙ্গের উপভাষা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে এটি প্রাচীন বঙ্গ কামরূপী ভাষা। আবার কেউ কেউ বলেন প্রাচীন বাংলা ভাষার নিদর্শন মাত্র। আমাদের অভিমত হলো, বাংলা ভাষাসহ উড়িয়া, অসমীয়া, মৈথিলী ইত্যাদি ভাষা ও বাংলা ভাষার উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষাগুলোর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে চর্যাপদের ভাষার মিল ছিল সুদূর কিংবা অদূর অতীতে, কিন্তু আজ আর নেই। সে ক্ষেত্রে কেবল ব্যতিক্রম সুনামগঞ্জসহ নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও হবিগঞ্জের- বলা ভাল প্রাচীন লাউড় রাজ্যের- আঞ্চলিক ভাষা। ব্যতিক্রমী প্রাচীন লাউড় রাজ্যের ভাষা ব্যতীত অন্যান্য উপভাষাগুলো দ্রুত পরিবর্তনের মাধ্যমে চর্যাপদের ভাষার সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রকে সম্পূর্ণভাবে ছিন্ন করেছে। প্রাচীন লাউড় রাজ্য ও তার আশপাশের কিছু এলাকার- বর্তমানের ভাটি বাংলা যাকে বলে- ভাষা আশ্চর্যরকমভাবে পরিবর্তনের দিক থেকে শ্লথগতিসম্পন্ন বিধায় চর্যাপদের ভাষার সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রটি আজও অক্ষুণ্ণ আছে। এই কারণেই সুনামগঞ্জের জনবসতিপূর্ণ এলাকায় চর্যাপদ কর্তাগণের উল্লেখযোগ্য অংশের বসবাস ছিল এবং তাঁদের উত্তরসূরীর মানসপুত্র অথবা ভাবশিষ্য অসংখ্য বৈষ্ণব-বাউলেরা এখনও এখানকার প্রকৃতি ও সমাজ-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে বিরাজ করেন। বাংলাদেশের অন্যত্র এমনটি বিরল দৃশ্য। আহমদ শরীফ যখন বলেন, ‘চর্যাপদের দেশেই বৈষ্ণব-বাউলের উদ্ভব, তখন মনে হয় চর্যাপদের দেশ বলতে সুনামগঞ্জকেই বুঝানো হয়েছে'।
সুনামগঞ্জ জেলার জনগণ সাধারণত বাংলা ভাষায় কথা বলেন। তবে জগন্নাথপুর, ছাতক, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার স্থানীয় জনগণ নিজেদের মধ্যে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। অন্যান্য উপজেলায় বিভিন্ন অঞ্চল যেমন সিলেট অঞ্চল, ময়মনসিংহ অঞ্চল, কুমিল্লা অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে।
সুনামগঞ্জ জেলার অধিবাসীরা সাহিত্য চর্চায় সিলেট বিভাগের পথিকৃৎ, এটা অত্যুক্তি নয়। শুধু বাংলা ভাষাতেই নয় এ জেলার অধিবাসীরা মোট সাতটি বিভিন্ন ভাষায় সাহিত্য চর্চার ঐতিহ্য রেখেছেন। এটিও এ জেলার অন্যতম রেকর্ড বলে মনে করি। পনের’শ শতাব্দী থেকে শুরু এ যাবৎ সুনামগঞ্জবাসীরা যে সমস্ত ভাষায় সাহিত্য রচনা করে গেছেন, সেগুলো হলো-(১) সংস্কৃত (২) বাংলা (৩) সিলেটি নাগরী (৪) আরবি (৫) ফার্সি (৬) উর্দু ও (৭) ইংরেজি।
সংস্কৃতি:
অসংখ্য হাওর-বাওর, নদীনালা, খালবিলে পরিবেষ্টিত জনপদ সুনামগঞ্জ। এ জনপদে ঐতিহ্য সংস্কৃতি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের সরব উপাদান। আউল-বাউলের চারণভূমি সুনামগঞ্জ তাঁর ঐতিহ্যের ধারা থেকে আজও বিচ্যুত হয়নি। লোকসাহিত্যে মহাভারতের অনুবাদক মহাকবি সঞ্চয় (পঞ্চদশ শতক), কুবের আচার্য্য, ঈশান নাগর (বৈষ্ণব কবি)দিব্য সিংহ (লাউর রাজ্যের স্বাধীন রাজা)থেকে শুরু করে সৈয়দ শাহনূর, সৈয়দ হোসেন আলম, রাধারমণ, হাছনরাজা, দুরবীণ শাহ, কালাশাহ, ছাবাল শাহ, এলাহী বক্স মুন্সী, শাহ আছদ আলী, পীর মজির উদ্দিন, আফজল শাহ, শাহ আবদুল করিম এ মাটির সন্তান। আধুনিক সাহিত্যে, গল্প-উপন্যাসে শাহেদ আলী, ঝর্ণাদাস পুরকায়স্থ, কবিতায় প্রজেশ কুমার রায়, মুতাসিম আলী, মোহাম্মদ সাদিক, আশরাফ আহমদ, ইকবাল কাগজী, মমিনুল মউজদীন, শামীম লুৎফর, গীতসাহিত্যে মনিরুজ্জামান মনির, দেওয়ান মহসিন রাজা চৌধুরী, সঙ্গীতে উজির মিয়া, নির্মলেন্দু চৌধুরী, এমরান আলী, শফিকুন্নর নুর, সাবিবর আহমদ সোহেল, নাটকে তরনী কান্ত দে, মোদাবিবর আলী টুনু, শাহ আবু তাহের, সদ্য প্রয়াত গোলাম রব্বানী, শিল্পকর্মে ধ্রুব এষ, সাংবাদিকতায় ফজলুল হক সেলবর্ষী, মকবুল হোসেন চৌধূরী, মুনাওর আলী, ইছাক আলী, হাসান শাহরিয়ার, সাকির আহমদ,শিক্ষায় মোহাম্মদ আলী, আব্দুল মন্নান চৌধুরী, আলী ফরিদ আহমদ, আব্দুল কাইয়ূম, সমাজসেবায় হাজী মকবুল হোসেন পুরকায়স্থ, সতীশ চন্দ্র রায়, দিগেন্দ্র চন্দ্র বর্মণ, ক্রীড়ায় সমশের আলী, আছদ্দর আলী ভূঁইয়া, কন্টর মিযা, নাজির আহমদ চৌধুরী উল্লেখযোগ্য।