হেরী সাহেব মাইলরে সোনার জৈন্তাপুর ছাতক তনে আইল হেরী যাইত বদরপুর। সিলেট আইয়া জিকার করে জইন্তা কতদূর। সাবাল বয়সী রাজেন্দ্র সিং মুখে রেখদাড়ী বান্দি থইল নিয়া মুরারী চান্দর বাড়ি হি দিন থাকি আন্দাইর অইল সোনার জৈইন্তাপুর বিনাদোষে মাইলোরে সোনার জাইন্তাপুর। (লোকগাঁথাঃ প্রাচীন গানটি)
একটি দেশের জন্ম হটাৎ করে হয়না। দীর্ঘ ইতিহাস, সংগ্রাম, শাসন, অত্যাচার প্রভৃতির সংযোজন-বিভাজন ঘটে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে একটি দেশের আর্বিভাব ঘটে বিশ্বের মানচিত্রে। বাংলাদেশ এক সময় ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল। স্বতন্ত্র শাসক-ব্যবস্থা থাকলেও সবাইকে চেয়ে থাকতে হত দিল্লীর মসনদের দিকে। অনেকে আবার দিল্লীর শাসন মেনে নিতে না পারার জন্য যুদ্ধে হেরে গিয়ে পলায়র বা মৃত্যুবরণ করেছেন আবার অনেকে যুদ্ধ করে করেই টিকে থেকেছেন। অনেকগুলো রাজ্যের মত বর্তমানে সিলেট-৪ আসনের অন্তগর্ত (উত্তর-পূর্বাংশ) প্রান্তিক জনপদ জৈন্তাপুর। আত্মসচেতনতার অভাব আর বহিরাগত কূটকৌশলের কাছে পরাজিত এখানকার সহজ-সরল অধিবাসীরা যদিও আজ ‘জৈন্তাপুরী’ হিসেবে তাচ্ছিল্যের পাত্ররূপে পরিচিত অনেকের কাছে।
সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পদানত তখন সম্রাট নিজামের এলাহাবাদ বাদে একমাত্র জৈন্তিয়া রাজ্যেই ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত আজাদীর প্রতীকরূপে ‘সিংহ চিহ্ন সংবলিত’ পতাকা উড়তো পত্ পত্ করে আর এ রাজ্যের অধিবাসীরাই বুক ফুলিয়ে সাহসের সাথে ঘোষণা করতে পারত যে, আমরা স্বাধীন। মালব দেশ হতে আগত কবিরাজ কর্তৃক ‘রাঘব পান্ডবীয় গ্রন্থ’ রচিত হয়েছিল এ জৈন্তারাজ্যেই-যা নিঃসন্দেহে সিলেট বাসীর গর্বের বিষয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্রতার ভিত্তি উপমহাদেশের ৫১টি পীঠস্থানের মধ্যে জৈন্তারাজ্যের ‘বাম জঙ্ঘা পীঠ’ অন্যতম। সিলেটের গৌড় ও লাউড়কে পাত্তা না দিলেও জৈন্তারাজ্য কৌরবদের সাম্রাজ্যভংক্ত হয় এবং পান্ডব অধ্যুষিত অঞ্চল হওয়ার গৌরব লাভ করে। হিন্দুদের প্রাচীন গ্রন্থাদিতে সিলেটের লাউড় ও গৌঢ় রাজ্যের উল্লেখ না থাকলেও প্রতিটি গ্রন্থে জৈন্তিয়া বা জয়ন্তার উল্লেখ আছে। জৈমিনি মহাভরত, মন্ত্রচুড়ামণি, তন্ত্রচুড়ামণি, কামাখ্যাতন্ত্র প্রভৃতি পৌরাণিক গ্রন্থে জৈন্তিয়া বা জয়ন্তার নাম উল্লেখিত হয়েছে সম্মানের সাথে।
প্রাচীনকালে জৈন্তারাজ্যকে নারীরাজ্য বলা হত। আর এ নারীরাজ্যের সঠিক বিস্তার জানা যায় না। তবে জৈন্তা পাহাড়কে কেন্দ্র করেই এ নারীরাজ্যের অবস্থান ছিল। খাসিয়া রাজবংশের সময় ষোড়শ শতক থেকে বারপুঞ্জি সংবলিত জৈন্তা পাহাড়, সিলেটের উত্তরাঞ্চলের সমতল ভূমি অর্থাৎ জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট ও কোম্পানীগঞ্জের কিছু অংশ এবং আসামের গোভা ও ডিমারূয়া অঞ্চল নিয়ে জৈন্তা রাজ্যের অবস্থান ছিল। এ রাজ্যের উত্তরে অহম (কামরূপ), পূর্বে কাছাড়, দক্ষিণে ত্রিপুরা ও গৌড় রাজ্য এবং পশ্চিমে লাউড় ও কামতা রাজ্যের অবস্থান ছিল। চতুর্দিকে বিভিন্ন রাজ্যের অবস্থানের কারণে পাশ্ববর্তী রাজন্যবর্গের সাথে জৈন্তা রাজ্যের সারা বছর ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকতো।
প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে লিখিত জৈমিনি মহাভারতে জৈন্তিয়া রাজ্যের অধিশ্বরী বীর রমণীর প্রমিলার কথা উল্লেখ করা আছে। জৈন্তিয়াকে প্রমিলা রাজ্য বা নারী রাজ্য বলা হতো। প্রমিলার রূপ-লাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে মহাবীর অর্জুন তাকে বিয়ে করেছিলেন। কহলীন রজত রঙ্গিনী গ্রন্থের বর্ণনা মতে, ‘কাশ্মীরের রাজা জয়পীড় এয়োদশ শতকের প্রথমার্ধে দ্বিগ্বিজয়ে বের হন।’ তিনি পূর্ব দেশীয় রাজা ভীমকে পরাজিত করে নেপাল রাজ্যে প্রবেশ করেন। তারপর তিনি জৈন্তিয়া রাজ্য জয় করেন। সে সময় জৈন্তিয়া পাহাড়কে কেন্দ্র করে জৈন্তা রাজ্যের সীমানা ছিল। ষোড়শ শতকে খাসিয়া রাজবংশের সময় থেকে জৈন্তা রাজ্যের অন্তর্গত অঞ্চল ছিল ১২ পুঞ্জি নিয়ে জৈন্তিয়া পাহাড় সিলেটের উত্তরাংশে সমতলভূমি নওগাঁ জেলার গোভা ও ভিমারণ্য অঞ্চল। রাজ্যের উত্তর-সীমায় অহম কামরুপ, পূর্বে-কাছার, দক্ষিণে-ত্রিপুরা ও গৌড় রাজ্য অবস্থান ছিল। ফলে সীমান্তবর্তী রাজন্যবর্গের সাথে সংঘর্ষ প্রায়ই লেগে থাকতো।
খাসিয়া রাজবংশের ২৩ জন রাজা ১৫০০ সাল থেকে ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত শাসনকার্য পরিচালনা করেন। খাসিয়াদের পূর্ব পুরুষরা চীনে তিব্বত থেকে জৈন্তিয়া রাজ্যে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীতে তারা হিন্দুদের সংস্পর্শে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেন। পর্বত চূড়ায় খাসিয়া রাজাদের রাজ্য পরিচালনা কেন্দ্রস্থল ছিল। পরবর্তীতে ১৬৮০ সালে পর্বত চূড়া হতে জৈন্তিয়ার নিজ পাটে রাজধানী স্থাপন করা হয়। বিভিন্ন শ্রেণীর লোকদেরকে ৩০টি হাটিতে ভাগ করা হয়। বন্দরহাটি, দর্জিহাটি, মুর্গাহাটি, নক্তিহাটি, মাহুতহাটি, মামতিহাটি, চৌরাহাটি, চুনাহাটি, তেলীহাটি, ধূনাহাটি, চন্দ্রাহািিট, আমতলীহাটি, তাংচুনীহাটি, দুয়াসিংহাটি, ওয়াশীহাটি, মজুমদারপাড়া, বামনপাড়া, গণকপাড়া, কুমারপাড়া, কামারপাড়া, বানিপাড়া, ফেরেঙ্গী টুলা, তাঁতীপাড়া, উজানীনগর, যশপুর ইত্যাদি নামরকণ করা হয়। ফতে খাঁ জৈন্তিয়াপুরের মোকাম বাড়ীতে প্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন। এই মসজিদ নির্মাণে সেনাপতি ফতে খাঁকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। রাজা লক্ষ্মী নারায়ণ প্রথম পর্বত থেকে সমতলে রাজধানী স্থাপন করেন। লক্ষ্মী নারায়ণের আমলে জৈন্তিয়া রাজ্যের রাজধানী রাজবাড়ী নির্মাণ, জৈন্তিয়াপুরী বাড়ী নির্মাণ, প্রকাশ্যে নরবলির স্থান, চন্ডির থাল এবং বিরাট বিরাট পাথরের তৈরী কেদার, ৮ ম তলা বড় দেউল, পান্তশালা, ঢুপীর মট এবং রাজ্য রক্ষার্থে বিরাট ক্ষমতাশালী ৪ টি কামানসহ বহু উন্নয়ন করেন।
হট্টনাথের পাঁচালীর বর্ণনা মতে, প্রাচীণকালে কামরূপে, কামসিন্ধু নামে এক রাজা রাজত্ব করতেন। তার মহিষী রাণী উর্মি। কামসিন্ধুর মৃত্যুর পর প্রাগজ্যোতিষপুরের অধিপতি কামরূপ আক্রমণ করলে নিরূপায় ও অসহায় রাণী রাজধানী ত্যাগ করে নিজ রাজ্যের পশ্চিমাংশে এবং নারী রাজ্যের কিছু অংশ দখল করে একটি নতুন রাজ্য স্থাপন করেন। তিব্বতের হাটক রাজ্যের যুবরাজ কৃষক ভারত ভ্রমণে বের হয়ে রাণী উর্মির স্থাপিত জৈন্তারাজ্যে উপস্থিত হয়। ঘটনাচক্রে রাণী উর্মির সুন্দরী কন্যা উর্বরা কৃষকের দৃষ্টিপাত পতিত হন। কৃষক উর্বরা’র রূপ লাবণ্যে মোহিত হয়ে তার প্রেমে পতিত হন। ভুলে যান পিতৃরাজ্য হাটকে প্রত্যাবর্তনের কথা। রাণী উর্মিও কৃষকের নানাগুণে মুগ্ধ হয়ে নিজ কন্যাকে কৃষকের সাথে বিয়ে দেন। কালক্রমে কৃষকের ঔরষে ঊর্বরা এক পুত্র সন্তান লাভ করেন। নবজাতকের নাম পিতামহের রাজধানীর নামানুসারে রাখা হয়-হাটক। যুবরাজ হাটক বয়ঃপ্রাপ্ত হলে মাতামহীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিব্বতের যুবরাজ ও রাজকুমারী উর্বরা’র স্বামী কৃষকের নামানুসারে এ বংশের নাম হয় কৃষক রাজবংশ এবং রাজবংশের কুলদেবতার নাম হয়-হাটকেশ্বর। রাজা হাটকের মৃত্যুর পর তার পুত্র গুহক সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং রাজ্যের সীমা বৃদ্ধি করেন। তার ছিল তিন পুত্র ও দুই কন্যা। পুত্রগণ হচ্ছেন লড্ডুক, গুড়ত, জয়ন্তক। গুহকের মৃত্যুর পর তার রাজ্য তিন পুত্রের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। লড্ডুকের অধিকৃত ভূমির নাম হয় ‘লাউড়’। গুড়কের অংশের নাম হয় ‘গৌঢ়’ এবং জয়ন্তকের অধিকৃত ভূমির নাম হয় ‘জয়ন্তিয়া’। গুহকপুত্র জয়ন্তকের নাম হতেই ‘জৈন্তিয়া’ নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
জয়ন্তকের মৃত্যুর পর রাজা হন জয়মল্ল, জয়মল্লের পর রাজা মহাবল সিংহাসনে আরোহণ করেন। মহাবলের পর যথাক্রমে রানচুড়দেব, বঙ্গবীর, কামদেব ও ভীমবলদেব জৈন্তার রাজা হন। ভীমবলই কৃষক বংশের শেষ রাজা। কামদেব ছাড়া এ বংশের অন্য রাজাদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। কামদেবের শাসনামলে জৈন্তিয়া রাজ্যের স্বর্ণযুগ হিসেবে খ্যাত ছিল রাজা কামদেব অত্যন্ত বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। তার আমন্ত্রণে মালব দেশের রাজধানী ধারানগর হতে বিখ্যাত পণ্ডিত ও কবি কবিরাজ জৈন্তার রাজসভায় আগমন করেন এবং ‘রাঘব পান্ডবীয় গ্রন্থ’ রচনা করেন। কামদেবের পর তার পুত্র রাজা ভীমবলদেব রাজা হন। ভীমবলদেব-এর কাছ থেকে রাজ পুরোহিতগণ সিংহাসন দখল করেন। এ ব্রাহ্মণ পুরোহিতগণের শেষ ৪ জন রাজা ছিলেন রাজা কেদারেশ্বর রায়, ধনেশ্বর রায়, কন্দর্প রায়, জয়ন্ত রায়। পুরোহিত রাজবংশের ইতিহাস অন্ধকার আচ্ছন্ন। কৃষক বংশের শেষ রাজা ভীমবলদেব দ্বাদশ শতকের শেষ দিকে রাজত্ব করেন। অপরদিকে খাসিয়া রাজবংশ ১৫০০ সাল হতে ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করে। রাজা ভীমবলের হাতে খাসিয়া রাজবংশের প্রথম রাজা পর্বত রাজ পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ২৫০ বছর এ পুরোহিত রাজবংশ জৈন্তরাজ্য শাসন করে। পুরোহিত রাজবংশের শেষ রাজা জয়ন্ত রায় নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি দেবতার নিকট সন্তান কামনা করলে দেবতার বরে জয়ন্তী নামে তার এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। এই কন্যা শৈষবে সুতুঙ্গা পুঞ্জিতে লালিত-পালিত হয়। কন্যা বয়ঃপ্রাপ্ত হলে সুতুঙ্গা পুঞ্জির খাসিয়া সর্দারের পুত্র লন্ডবের সাথে তার বিয়ে হয়।
রাণী জয়ন্তী ও লন্ডবরের সন্তান পর্বত রায়ই খাসিয়া রাজবংশের আদি রাজা। তার রাজত্ব কাল ১৫০০ থেকে ১৫১৬ সাল পর্যন্ত ছিল বলে জানা যায়। পর্বত রায়ের পর রাজা হন মাঝ গোসাই। তিনি ১৫১৬ হতে ১৫৩২ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। এরপর বুড়া পর্বত রায় জৈন্তারাজ্য শাসন করেন। তার রাজত্বকাল ছিল ১৫৩২ সাল হতে ১৫৪৮ সাল পর্যন্ত। বুড়া পর্বত রায়ের পর প্রথম বড় গোসাই জৈন্তার রাজা হন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক ও ন্যায়পরায়ণ। তার সময়েই ফালজুরের বাম-জঙ্ঘা পীঠ প্রকাশিত হয়। এর কিছুদিন পর নিজপাটের উত্তর দিকস্থ রূপনাথ গুহায় রূপনাথ শিবও আবিষ্কৃত হয়। ১৫৪৮ সাল হতে ১৫৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেন।
প্রথম বড় গোসাই এর পর ১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দে বিজয় মানিক সিংহাসনে আরোহণ করেন। এ সময় ত্রিপুরার প্রভাবশালী শাসক বিজয় মানিক্যের জন্য মিত্রতার জন্য বিজয় মানিক্য মূল্যবান উপঢৌকন পাঠান। প্রতিদানে বিজয় মানিক্য জৈন্তাপতিকে একটি হাতী দান করেন। এ সময়ে কামরূপের কোচ বংশীয় রাজা নবনারায়ণের ভাই ও সেনাপতি চিলারায় কাছাড় ও মণিপুর জয় করে জৈন্তারাজ্যে আক্রমণ করেন। বিজয় মানিক্য স্বসৈন্যে চিলারায়ের গতিরোধ করলেও দুর্ভাগ্যবশতঃ তিনি মারা যান এবং চিরারায়ের জয় হয়। বিজয় মানিক্যের উত্তরাধিকারী প্রতাপ নারায়ণ কামরূপ রাজকে বার্ষিক দশ হাজার টাকা, ৭০টি ঘোড়া এবং ৩০০ খানা লসেই দাও দিতে সম্মত হয়ে হারানো রাজ্য ফিরে পান। সন্ধির শর্তানুসারে রাজা নিজ নামে মুদ্রা প্রচলনের অধিকার হতে বঞ্চিত হন। তিনি ১৫৮৫ হতে ১৫৯৬ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। প্রতাপ নারায়ণের পর ধনমানিক সিংহাসন লাভ করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ক্ষমতাবান রাজা। ১৬০২ সালে তিনি দিমারুয়ার রাজা প্রভাকরকে যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী করেন। প্রভাকরের অনুরোধে কাছাড় রাজ শত্র“দমন জৈন্তারাজ্যে আক্রমণ করলে ধনমানিক পরাজিত হন। পরে কাছাড় রাজের কাছে আপন কন্যাদ্বয়কে নিয়ে দিয়ে সন্ধি স্থাপন করেন। অধিকন্তুু নিজ ভাগিনে ও উত্তরাধিকারী যশোমণিককে প্রতিভূম্ব রূপ কাছাড়ের রাজধানী ব্রহ্মপুরে প্রেরণ করেন। ১৫৯৬ হতে ১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি জৈন্তারাজ্য শাসন করেন। ধনমানিকের মৃত্যুর পর ১৬০৬ সালে কাছাড়রাজ শত্র“দমন যশোমানিককে মুক্তি দেন। যশোমানিক দেশে ফিরে আসেন এবং সিংহাসন লাভ করেন। তারই কূটকৌশলে অহমরাজ প্রতাপ সিংহ ও শত্র“দমনের মধ্যে ১৬১৮ সালে যুদ্ধ হয় যাতে প্রথমে কাছাড়রাজ পরাজিত হন। তার সময়েই যৌতুকরূপে প্রাপ্ত দেবী মূর্তিকে ‘জৈন্তশ্বরী কালী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
যশোমানিকের মৃত্যুর পর ১৬২৫ সালে সুন্দর রায় সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ১৬৩৬ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। পরবর্তীতে ১৬৩৬ সালে ছোট পর্বত রায় সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ১৬৪৭ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ছোট পর্বত রায়ের মৃত্যুর পর ১৬৪৭ সালে যশোমন্ত রায় সিংহাসনে আরোহণ করেন। মীর জুমলার শাসনকালে যশোমন্ত রায় সিলেট শহর আক্রমণ করলেও শায়েস্তা খানের আগমন সংবাদে ১৬৬৪ সালে তিনি মোগলদের আনুগত্য স্বীকার করেন। যশোমন্ত রায়ের মৃত্যুর পর ১৬৬৮ সালে তার দৌহিত্র বানসিংহ রাজা হন। ছয় মাসের ভিতরেই তিনি প্রতাপ সিংহ কর্তৃক নিহত হন। ১৬৬৯ সালে প্রতাপ সিংহ
সিলেট জেলা কমলালেবু, চাপাতা, সাতকড়ার আচার এবং সাত রঙের চা এর জন্য বিখ্যাত। সিলেট জেলাটি বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত।
মৌলভীবাজার এর অর্থনীতির প্রধান ভীত হলো চা শিল্প ও রাবার শিল্প । এ জেলায় প্রচুর পরিমানে চা ও রাবার উৎপাদিত হয় । এ ছাড়াও এ জেলার অর্থনীতিতে এই জেলার পর্যটন শিল্পও বিশেষ ভাবে উল্ল্যেখযোগ্য, তা ছাড়াও এখানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের ছোট বড় শিল্প যা মৌলভীবাজার জেলার অর্থনীতিকে করছে সমৃদ্ধশালী ।
ইতিহাস গবেষক দেওয়ান নুরুল আনওয়ার জালালাবাদের কথা গ্রন্থে লিখেছেন খ্রিস্টিয় সপ্তম শতক পর্যন্ত সিলেট কামরুপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল।
সবচেয়ে প্রচলিত ধারণাটি হলো, শিলা মানে পাথর। আর পাথরের প্রাচুর্যের কারণেই এ এলাকার নাম সিলেট। এ ধারণার পালে আর একটু হাওয়া দিয়ে বলা হয়ে থাকে, সিলেট শব্দের অনুসর্গ সিল মানে শীল বা পাথর আর উপসর্গ হেট মানে হাট বা বাজার। প্রাচীনকাল থেকে এ জেলায় পাথর ও হাটের আধিক্য থাকায় শব্দ দু'টি মিলে সিলেট নামের উৎপত্তি।
সিলেট জেলার ভৌগোলিক অবস্থান ২৪° ৪০’ থেকে ২৫° ১১’’ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১° ৩’’ থেকে ৯২° ৩’’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। সিলেট জেলার উত্তরে ভারতের মেঘালয় ও খাশিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়, পূ্র্বে ভারতের আসাম, দক্ষিণে মৌলভীবাজার জেলা ও পশ্চিমে সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলা অবস্থিত। এই জেলার আয়তন ৩,৪৯০.৪০ বর্গ কিমি। বাৎসরিক সর্বচ্চো তাপমাত্রা ৩৩.২° সেলসিয়াস ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৩.৬° সেলসিয়াস। বাৎসরিক বৃষ্টিপাত ৩৩৩৪ মিলিমিটার। প্রধান নদী সুরমা ও কুশিয়ারা। হাওড় সংখ্যা ৮২ টি। সংরক্ষিত বনাঞ্চল ২৩৬.৪২ বর্গ কিলোমিটার। ভারতের খাশিয়া-জয়ান্তা পাহারের কিছু অংশ এই জেলায় পরেছে। এছাড়াও কিছু ছোট পাহাড় ও টিলা রয়েছে এখানে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জৈন্তাপুর (৫৪ মাইল), সারি টিলা (৯২ মাইল), লালখান টিলা (১৩৫ মাইল), ঢাকা দক্ষিণ টিলাসমূহ (৭৭.৭ মাইল)।