১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল সাধারণ নির্বাচনের পরে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠি ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে যখনই টালবাহান শুরু হল। তখনই সমগ্র বাঙালী জাতি বুঝতে পারল বাঙালীর তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছাড়া বিকল্প নেই। বাঙালী জাতীর একমাত্র অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের একটি নির্দেশের অপেক্ষা রয়েছে সাত কোটি বাঙালী। প্রিয় নেতা কখন, স্বাধীনতার জন্য জনযুদ্ধের ডাক দেন। অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দান লাখো লাখো জনতায় সমগ্র মাঠটি কানায় কানায় পরিপূর্ণ। এছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ স্বাধীনতার যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত। মুক্তিকামী মানুষের শুধু একটিই আবেগ ছিল প্রিয় নেতা কখন নির্দেশ দিবে। অবশেষে মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ডাক ‘‘এ বারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’’ ‘‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’’ ঘরে ঘরে দুর্গ করে তোল । শত্রুর মোকাবেলা করে এ দেশকে স্বাধীনু করতে হবে। মহান নেতার এই ভাষণ প্রতিটি মুক্তিকামী জনতার মনে দীক্ষমন্ত্রের মতো কাজ করতে লাগলো। ৭১’র ২৫ মার্চ ঘুমন্ত মানুষের উপর রাতের অন্ধকারে পশ্চিম পাকিস্তানী কাপুরুষ শাসক গোষ্ঠির অতর্কিত হামলা।
৮ ডিসেম্বর ঝালকাঠি ও নলছিটি উপজেলা পাক হানাদার মুক্ত দিবস । একাত্তরের এই দিনে ঝালকাঠি জেলা সম্পুর্নভাব শত্রুমুক্ত হয়। ঘরে ঘরে ওড়ে বিজয়ের লাল সবুজের পতাকা ।ঝালকাঠির রনাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা মফিজ উদ্দিন জানান, জেলার নলছিটি উপজেলায় রনাঙ্গন একমাত্র সম্মুখ যুদ্ধ্স্থান চাচৈরের প্রচন্ড বেগে যুদ্ধ শুরু হয় ১৩ নভেম্বর। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। মুক্তিযোদ্ধা আউয়াল এ যুদ্ধে শহীদ হলেও বহু পাকসেনা প্রাণ হাড়ায়। নলছিটি ১৫ নভেম্বর থানা কমান্ডার সেকান্দার আলীর নেতৃত্বে নলছিটি থানা আক্রমন হয়।
সেখানে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মাহমুদ চৌধুরীর মেয়ে সহ কয়েক হানাদার প্রাণ হারায়। ৭ ডিসেম্বর রাতে শহরে র্কাফু ঘোষনা করে । এদিন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সেকান্দার আবার থানা আক্রমন করে। এতে পাকসেনা, রাজাকার, আলবদরদের পরাজয় ঘটে। তাই সব বাহিনীকে নিরস্ত্র করে মুক্তিযোদ্ধারা তালতলা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরদিন ৮ ডিসেম্বর সকালে যাকে দেখা যাবে তাকেই গুলি করে হত্যা করা হবে । আর এ র্কাফু ঘোষনা দিয়ে পাকবাহিনী ঝালকাঠি শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। বিকেলে স্থানীয় রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আত্মসর্মাপন করে। সে দিন সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধারা ঝালকাঠি সদর ও নলছিটি থানা দখলে নেয়। এরপর পুরো জেলা মুক্তিযোদ্দাদের নিয়ন্ত্রনে চলে আসে।
স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও অরক্ষিত রয়েছে ঝালকাঠির শহীদের বধ্যভূমিগুলো।
জানাগেছে, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনী নির্মম অত্যাচার চালায় স্বাধীনতাকামী ঝালকাঠি’র বিভিন্ন স্থানে। পাকবাহিনীর নির্মম অত্যাচারের স্বাক্ষী ঝালকাঠি’র বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের অভাবে বর্তমানে প্রায় নিশ্চিহ্ন হবার পথে। দেশের জন্য আত্মত্যাগী শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় স্বাধীনতার পর ৪০ বছর অতিবাহিত হলেও বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ কিংবা কোন স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়নি। জেলা প্রশাসন ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সুত্রে জানাগেছে, ঝালকাঠি জেলায় এ পর্যন্ত ২০ টি বদ্ধভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১৪টি, নলছিটিতে ৪টি, রাজাপুরে ২টি ও কাঁঠালিয়া ২টি বদ্ধভূমি রয়েছে। এর সবগুলোই অরক্ষিত রয়েছে। ঝালকাঠি জেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি ছিল পৌর শহরের সুগন্ধা নদীর পাড়ে। এখানে ৭১ সালের ৩০ মে একদিনেই ১০৮ জন বাঙালীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। স্থানটি এক পর্যায়ে সুগন্ধা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও বর্তমানে সে স্থানটিতে চর জেগে উঠেছে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সেচ্ছায় আত্মদানকারী শহীদের স্মৃতি রক্ষায় বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় মুক্তিযোদ্ধাসহ স্বাধীনতা স্বপক্ষের মানুষের মনে চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে।
১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পূর্ণাঙ্গ জেলা হিসেবে ঝালকাঠি জেলা প্রতিষ্ঠিত হলে ঝালকাঠি শহরকে জেলা শহরের মর্যাদা দেওয়া হয়।
একাত্তরের ২৩ নভেম্বর ৯নং সেক্টরের মধ্যে এ জনপদ সবার প্রথম হানাদার মুক্ত হয়েছিলো।
নদী বন্দরের জন্য ঝালকাঠি সবসময় ইউরোপীয়দের আকর্ষণ করেছে। ফলে বিভিন্ন সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ডাচ ও ফরাসিরা এখানে ব্যবসা কেন্দ্র খুলেছিল। বাণিজ্যিক গুরুত্বের জন্য ঝালকাঠিকে দ্বিতীয় কলকাতা বলা হত। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ঝালকাঠি সদর উপজেলার রেজাউল করিম ২৪ সদস্য বিশিষ্ট মানিক বাহিনী গড়ে তোলেন।
ঝালকাঠির জনপ্রিয় খাবার: ঝালকাঠি প্রাকৃতিক ফল যেমন আম, কলা, জলপাই, কাঠাল, তাল, লিচু, নারিকেল, আমড়া, পেয়ারা।
শহরটির অবস্থানের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ হল ২২.৬৪০৮৯৩° উত্তর ৯০.১৯৮৮০৩° পূর্ব। সমুদ্র সমতল থেকে শহরটির গড় উচ্চতা ১১ মিটার। ঝালকাঠী শহর ঢাকা থেকে ১৯৫ কি.মি. দক্ষিণে এবং বরিশাল বিভাগীয় শহর থেকে ২০ কি.মি. পশ্চিমে সুগন্ধা নদীর তীরে অবস্থিত। সুগন্ধা নদী থেকে বাসন্ডা খাল নামে একটি শাখা নদী উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে শহরকে দু'ভাগে বিভক্ত করেছে। শহরের ভিতরে আরও ১২টি খাল প্রবহমান রয়েছে।