১৬৯১ সালের দিকে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে হুগলির মহামাণিক্য দত্ত আসামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। যাত্রাপথে তিনি কালিদহ নিম্নভূমির পাশ দিয়ে যান এবং এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিস্মিত হন। ফলে তিনি বর্তমান ধর্মপাশায় সুখাইরে একটি জায়গির ক্রয় করেন। ১৬৯৫ সালে, জমিদার মোহনলাল সুখাইর জায়গিরের মধ্যে একটি বড় প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন এবং ২০টি জলাভূমির উপর তাদের কর্তৃত্ব ছিল। মাইয়ুক চৌধুরীর জমিদারির সময় একজন ইংরেজ অফিসার বাঘ শিকারের জন্য টাঙ্গুয়ার হাওরে গিয়েছিলেন। ইংরেজ অফিসার তিনটি বাঘের দ্বারা বন্দী হন এবং এই খবর জমিদারের কাছে পৌঁছলে তিনি বাঘকে মুক্ত করতে গুলি করে আইন ভঙ্গ করেন। চৌধুরীকে পরে তার পরিষেবার জন্য একটি বন্দুক দেওয়া হয়েছিল। দত্ত থেকে রাই-চৌধুরী পদবি পরিবর্তনের কারণ মলয় রায় চৌধুরী ব্যাখ্যা করেছেন যে তার পূর্বপুরুষদের মধ্যে একজন সুখাইরে আসার সময় একজন দাসকে বিয়ে করেছিলেন। মহামাণিক্য দত্তের চতুর্থ বংশধর প্রতাপ রায়-চৌধুরী ইসলাম গ্রহণ করেন এবং নিকটবর্তী রাজাপুরের একটি উচ্চবিত্ত মুসলিম পরিবারের একজন মহিলাকে বিয়ে করেন। তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে সুখাইরের জমিদারির অর্ধেক পেয়েছিলেন এবং পরে রাজাপুরের জমিদার হন।
১৭৮৭ সালে, লাউড়ের খাসিরা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাদের অনেক পরগণা লুণ্ঠন করে (আধুনিক ধর্মপাশা উপজেলার বংশীকুন্ডা, রামদিঘা এবং সেলবারাসসহ) এবং ৮০০ জনকে হত্যা করে। সিলেটের ব্রিটিশ কালেক্টর রবার্ট লিন্ডসে এই এলাকায় সৈন্য পাঠান কিন্তু তারা পৌঁছানোর আগেই খাসিরা তাদের পাহাড়ে ফিরে যায়। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন, একটি ভূমিকম্পের সময় এলাকাটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যার ফলে অনেকের মৃত্যু হয়েছিল। ১৯২২ এবং ১৯২৩ সালের মধ্যে, সুখাইর নানকার বিদ্রোহের একটি বিশিষ্ট এলাকা হয়ে ওঠে। সেলবরাস জমিদার পরিবারের গোলাম জিলানী চৌধুরী ১৯৩০-এর দশকে আশরাফুন্নেসা চৌধুরানীকে বিয়ে করেন।
তাদের ছেলে, আহমদ তৌফিক চৌধুরী, আহমদিয়া আন্দোলনে যোগদান করেন যেখানে তিনি খুদ্দাম-উল আহমদিয়ার আঞ্চলিক নেতা হন এবং পরে ময়মনসিংহে চলে যান যেখানে তিনি স্বাধীনতার পর আহমদিয়া মুসলিম জামাত বাংলাদেশের আমীর হন। ১৯৪২ সালে ধর্মপাশায় একটি থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৭ সালে বিষরা গ্রামে এক রাতে গুটি বসন্তে ৫০ জন মারা যায়। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ধর্মপাশা থানাকে উপজেলায় (উপজেলা) উন্নীত করা হয়। তিন বছর পর ধর্মপাশা উপজেলায় মধ্যনগর থানা নামে একটি দ্বিতীয় থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০২১ সালের ২৬ জুলাই, খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম মধ্যনগর উপজেলা প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন, যা কার্যকরভাবে ধর্মপাশা উপজেলাকে হ্রাস করে।
সুনামগঞ্জ জেলা লোক সংগীত এর জন্য বিখ্যাত। বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের জন্ম সুনামগঞ্জে, হাসন রাজা, রাধরমন দত্ত, দূরবীন শাহ, ক্বারি আমির উদ্দিন এবং আরো অনেক সনামধন্য বাউল এর জন্ম সুনামগঞ্জে হয়েছে। সুনামগঞ্জে অনেক দর্শনীয় জায়গা রয়েছে যেমন, নীলাদ্রি লেক, টাংগুয়ার হাওর, শিমুল বাগান, যাদুখুটা নদী ইত্যাদি।
স্বাধীনতাযুদ্ধে সুনামগঞ্জ জেলা ছিল জাতীয়ভাবে বিভক্ত সেক্টর-৫ এর অন্তর্গত। ৫নং সেক্টরের বিস্তৃতি মূলত সুনামগঞ্জ জেলা বা সাবেক সুনামগঞ্জ মহকুমাব্যাপী। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল মীর শওকত আলী। সুনামগঞ্জ জেলা স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ মুক্তিযুদ্ধের সূচনা থেকে শেষ পর্যন্ত গৌরবজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে।
সুনামগঞ্জ জেলা আয়তন: ৩,৬৬৯.৫৮ বর্গ কিমি। অবস্থান: ২৪°৩৪´ থেকে ২৫°১২´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯০°৫৬´ থেকে ৯১°৪৯´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ।
১৭৭৪ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সময় জর্জ ইংলিশ ব্যবসার করার জন্যে স্ব-পরিবারে এখানে অবস্থান করে চুনা পাথরের ব্যবসার আরো প্রাতিষ্টানিক রূপ দেন। সে সময়ে ছাতক চুনশিল্পে সারা বিশ্বে পরিচিতি ও খ্যাতি অর্জন করে।
ভাষা
সুনামগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে প্রাচীন চর্যাপদের ভাষার মিল পরিলক্ষিত হয়। অন্য অঞ্চলের সঙ্গেও এমন দাবী যুক্তিযুক্ত। অন্তত বিশেষজ্ঞদের অভিমত এমনটিই। পণ্ডিত সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, চর্যাপদের ভাষা পশ্চিমবঙ্গের উপভাষা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে এটি প্রাচীন বঙ্গ কামরূপী ভাষা। আবার কেউ কেউ বলেন প্রাচীন বাংলা ভাষার নিদর্শন মাত্র। আমাদের অভিমত হলো, বাংলা ভাষাসহ উড়িয়া, অসমীয়া, মৈথিলী ইত্যাদি ভাষা ও বাংলা ভাষার উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষাগুলোর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে চর্যাপদের ভাষার মিল ছিল সুদূর কিংবা অদূর অতীতে, কিন্তু আজ আর নেই। সে ক্ষেত্রে কেবল ব্যতিক্রম সুনামগঞ্জসহ নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও হবিগঞ্জের- বলা ভাল প্রাচীন লাউড় রাজ্যের- আঞ্চলিক ভাষা। ব্যতিক্রমী প্রাচীন লাউড় রাজ্যের ভাষা ব্যতীত অন্যান্য উপভাষাগুলো দ্রুত পরিবর্তনের মাধ্যমে চর্যাপদের ভাষার সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রকে সম্পূর্ণভাবে ছিন্ন করেছে। প্রাচীন লাউড় রাজ্য ও তার আশপাশের কিছু এলাকার- বর্তমানের ভাটি বাংলা যাকে বলে- ভাষা আশ্চর্যরকমভাবে পরিবর্তনের দিক থেকে শ্লথগতিসম্পন্ন বিধায় চর্যাপদের ভাষার সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রটি আজও অক্ষুণ্ণ আছে। এই কারণেই সুনামগঞ্জের জনবসতিপূর্ণ এলাকায় চর্যাপদ কর্তাগণের উল্লেখযোগ্য অংশের বসবাস ছিল এবং তাঁদের উত্তরসূরীর মানসপুত্র অথবা ভাবশিষ্য অসংখ্য বৈষ্ণব-বাউলেরা এখনও এখানকার প্রকৃতি ও সমাজ-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে বিরাজ করেন। বাংলাদেশের অন্যত্র এমনটি বিরল দৃশ্য। আহমদ শরীফ যখন বলেন, ‘চর্যাপদের দেশেই বৈষ্ণব-বাউলের উদ্ভব, তখন মনে হয় চর্যাপদের দেশ বলতে সুনামগঞ্জকেই বুঝানো হয়েছে'।
সুনামগঞ্জ জেলার জনগণ সাধারণত বাংলা ভাষায় কথা বলেন। তবে জগন্নাথপুর, ছাতক, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার স্থানীয় জনগণ নিজেদের মধ্যে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। অন্যান্য উপজেলায় বিভিন্ন অঞ্চল যেমন সিলেট অঞ্চল, ময়মনসিংহ অঞ্চল, কুমিল্লা অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে।
সুনামগঞ্জ জেলার অধিবাসীরা সাহিত্য চর্চায় সিলেট বিভাগের পথিকৃৎ, এটা অত্যুক্তি নয়। শুধু বাংলা ভাষাতেই নয় এ জেলার অধিবাসীরা মোট সাতটি বিভিন্ন ভাষায় সাহিত্য চর্চার ঐতিহ্য রেখেছেন। এটিও এ জেলার অন্যতম রেকর্ড বলে মনে করি। পনের’শ শতাব্দী থেকে শুরু এ যাবৎ সুনামগঞ্জবাসীরা যে সমস্ত ভাষায় সাহিত্য রচনা করে গেছেন, সেগুলো হলো-(১) সংস্কৃত (২) বাংলা (৩) সিলেটি নাগরী (৪) আরবি (৫) ফার্সি (৬) উর্দু ও (৭) ইংরেজি।
সংস্কৃতি:
অসংখ্য হাওর-বাওর, নদীনালা, খালবিলে পরিবেষ্টিত জনপদ সুনামগঞ্জ। এ জনপদে ঐতিহ্য সংস্কৃতি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের সরব উপাদান। আউল-বাউলের চারণভূমি সুনামগঞ্জ তাঁর ঐতিহ্যের ধারা থেকে আজও বিচ্যুত হয়নি। লোকসাহিত্যে মহাভারতের অনুবাদক মহাকবি সঞ্চয় (পঞ্চদশ শতক), কুবের আচার্য্য, ঈশান নাগর (বৈষ্ণব কবি)দিব্য সিংহ (লাউর রাজ্যের স্বাধীন রাজা)থেকে শুরু করে সৈয়দ শাহনূর, সৈয়দ হোসেন আলম, রাধারমণ, হাছনরাজা, দুরবীণ শাহ, কালাশাহ, ছাবাল শাহ, এলাহী বক্স মুন্সী, শাহ আছদ আলী, পীর মজির উদ্দিন, আফজল শাহ, শাহ আবদুল করিম এ মাটির সন্তান। আধুনিক সাহিত্যে, গল্প-উপন্যাসে শাহেদ আলী, ঝর্ণাদাস পুরকায়স্থ, কবিতায় প্রজেশ কুমার রায়, মুতাসিম আলী, মোহাম্মদ সাদিক, আশরাফ আহমদ, ইকবাল কাগজী, মমিনুল মউজদীন, শামীম লুৎফর, গীতসাহিত্যে মনিরুজ্জামান মনির, দেওয়ান মহসিন রাজা চৌধুরী, সঙ্গীতে উজির মিয়া, নির্মলেন্দু চৌধুরী, এমরান আলী, শফিকুন্নর নুর, সাবিবর আহমদ সোহেল, নাটকে তরনী কান্ত দে, মোদাবিবর আলী টুনু, শাহ আবু তাহের, সদ্য প্রয়াত গোলাম রব্বানী, শিল্পকর্মে ধ্রুব এষ, সাংবাদিকতায় ফজলুল হক সেলবর্ষী, মকবুল হোসেন চৌধূরী, মুনাওর আলী, ইছাক আলী, হাসান শাহরিয়ার, সাকির আহমদ,শিক্ষায় মোহাম্মদ আলী, আব্দুল মন্নান চৌধুরী, আলী ফরিদ আহমদ, আব্দুল কাইয়ূম, সমাজসেবায় হাজী মকবুল হোসেন পুরকায়স্থ, সতীশ চন্দ্র রায়, দিগেন্দ্র চন্দ্র বর্মণ, ক্রীড়ায় সমশের আলী, আছদ্দর আলী ভূঁইয়া, কন্টর মিযা, নাজির আহমদ চৌধুরী উল্লেখযোগ্য।