ক্রমশ জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ১৮৫৪ সালের সিংখালী বিদ্রোহ, উপুর্যপরি বলেশ্বর, দামোদর, কচুয়া ও কালিগঙ্গা নদীতে নৌ-ডাকাতির উত্পাত বন্ধ করার লক্ষ্যে ১৮৫৬ সালে বাখরগঞ্জের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এইচ, এ, আর আলেকজান্ডার বর্তমান পিরোজপুর অঞ্চলে একটি মহকুমা সৃষ্টির প্রস্তাব করেন। কিন্তু ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ হওয়ার কারণে তা কিছুটা বিলম্বিত হয়। অতঃপর ১৮৫৯ সালের ২৮ অক্টোবর পিরোজপুর মহকুমা স্থাপিত হয়। এর আগে পিরোজপুর ছিল টগরা থানার একটি গ্রাম। তখন টগরা, কাউখালী ও কেওয়ারী থানা ছাড়াও তৎকালীন যশোর (বর্তমান বাগেরহাট) জেলার কচুয়া ছিল পিরোজপুর মহকুমার অন্তর্ভুক্ত। ১৮৬৩ সালে রেভিনিউ সার্ভের পরে বাগেরহাট মহকুমার সৃষ্টি হলে কচুয়া পিরোজপুর মহকুমা থেকে আলাদা হয়।
পিরোজপুরে মহকুমা সৃষ্টির পূর্বেই কাউখালীতে মুন্সেফি আদালত অফিস স্থাপিত হয়েছিল। ফলে মহকুমার প্রথমদিকের কাজকর্ম ১৮৬৬ সাল পর্যন্ত চলতো কাউখালীতে। পিরোজপুর মুন্সেফি আদালত, মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের দফতর স্থাপনের জন্য রায়েরকাঠির জমিদার রাজকুমার রায় ও তদীয় পত্নী হেরিয়েটা লুকাস একটি দ্বিতল ভবন প্রদান করলে কাউখালী থেকে মহকুমা কার্যালয় পিরোজপুরে স্থানান্তরিত হয়। এ সময় টগরা থানা ও পাড়েরহাট থেকে স্থানান্তরিত হয় পিরোজপুরে। ১৮৬৫ সালে পিরোজপুরে সাবরেজিস্ট্রি অফিস, দাতব্য চিকিত্সালয় ও মুন্সেফ আদালতে দেওয়ানী মোকাদ্দমা শুরু হলে পূর্ণাঙ্গ মহকুমার কার্যক্রম শুরু হয়। উল্লেখ্য যে, ১৭৮১ সাল থেকে ১৭৯৭ সাল পর্যন্ত পিরোজপুর ছিল ঢাকা দেওয়ানী আদালতের অধীন এবং ১৭৯৭ থেকে ছিল বাখেরগঞ্জের অধীনে। কাউখালী মুন্সেফ আদালতের অধীনে প্রথমে কেওয়ারী ও টগরা পরে মঠবাড়িয়া থানা যুক্ত হয়। ১৮৭৩ সালে বিচারিক কাজের সুবিধার্থে জেলখানা, ১৮৮৫ সালের ১লা জুলাই পিরোজপুর মিউনিসিপ্যালিটি, ১৮৮৭ সালে লোকাল বোর্ড এবং উনিশ শতকের শেষের দিকে পিরোজপুরে বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে পিরোজপুরে নাগরিক সুবিধাসহ শহর গড়ে ওঠে।
অন্যদিকে, জনবৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে পিরোজপুর মহকুমার থানার সংখ্যা বৃদ্ধি ও পুনঃবিন্যাস করা হয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে পিরোজপুর অঞ্চলে জনবৃদ্ধি ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় পুলিশী সার্কেলগুলোর পুনঃবিন্যাস ঘটে এবং নতুন থানার সৃষ্টি হয়। ১৮২৪ সালে বারৈকরণ থানা বিভক্ত করে ঝালকাঠি ও নলছিটি থানা গঠন করা হয়। ১৮৫৯ সালে বর্তমান ভাণ্ডারিয়া, কাঠালিয়া, পাথরঘাটা ও বামনা থানা অঞ্চলের ১৫৬ ব.মা. আয়তন নিয়ে মঠবাড়িয়া থানার সৃষ্টি হয়। ১৮৬৩ সালে পিরোজপুর মহকুমা থেকে কচুয়া থানা আলাদা হয়ে তৎকালীন যশোর জেলাভুক্ত হয়। ১৮৭২ সালে মঠবাড়িয়া সার্কেলের অধীনে ভাণ্ডারিয়ায় পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়। পরে ১৯১২ সালে পূর্ণাঙ্গ পুলিশ স্টেশনে পরিণত করা হয়।
এ সময় প্রতিটি থানায় ১জন সাব ইন্সপেক্টর, ২ জন হেড কনস্টেবল ও ১২জন কনস্টেবল নিয়ে গঠিত হত। ১৮৬০ সালের পরে চৌকিদারী ও দফাদারী ব্যবস্থা চালু হলে থানার অধীনে তাদের ন্যস্ত করা হয়। ১৯০৬ সালে স্বরূপকাঠিকে বিভক্ত করে নাজিরপুর এবং ১৯১০ সালে বানারিপাড়া থানা সৃষ্টি হয়। পূর্বের কেওয়ারি থানা স্থানান্তরিত হয় স্বরূপকাঠিতে। ১৯৬৯ সালে বরগুনা মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হলে বামনা ও পাথরঘাটা থানাকে বরগুনা মহকুমার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৭০ সালে ঝালকাঠি মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হলে পিরোজপুর মহকুমা হতে কাঁঠালিয়া থানাকে ঝালকাঠির সাথে যুক্ত করা হয়। ১৯৭৬ সালে পিরোজপুর সদর থানা থেকে আলাদা করে ইন্দুরকানি থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০২ সালে উপজেলা পদ্ধতি চালু হলে এ উপজেলার নামকরণ করা হয় 'জিয়ানগর'। ১৯৮৪ সালে মহকুমাগুলো জেলায় উন্নীত হলে ৭টি উপজেলার ৬৪৫টি গ্রাম নিয়ে পিরোজপুর জেলা গঠিত হয়। উপজেলাগুলো হচ্ছে ভাণ্ডারিয়া, কাউখালী, মঠবাড়িয়া, নাজিরপুর, নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) পিরোজপুর সদর ও ইন্দুরকানী। ১৯৮৮ সালে গঠিত হয়েছে পিরোজপুর জেলা পরিষদ।
পিরোজপুর জেলা নারিকেল, সুপারি, পেয়ারা, আমড়া এর জন্য বিখ্যাত।
প্রবাদ প্রবচন ও বিয়ের গানের জন্য পিরোজপুর বিখ্যাত। বর্তমানে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, দিশারী শিল্পী গোষ্ঠী,সংগীতা, ধ্বনি শিল্পী গোষ্ঠী, রুপান্তর নাট্য গোষ্ঠী, পিরোজপুর থিয়েটার, কৃষ্ণচুড়া থিয়েটার, বলাকা নাট্যম্ প্রভৃতি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী আঞ্চলিক ঐতিহ্য লালন পালন ও প্রচারে একাগ্র প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুর ছিল মুক্তিযুদ্ধের নবম সেক্টরের অধীন সুন্দরবন সাব-সেক্টর মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ এর কমান্ডের আওতায়।
পিরোজপুরের উত্তরে বরিশাল জেলা ও গোপালগঞ্জ জেলা, দক্ষিণে বরগুনা জেলা, পূর্বে ঝালকাঠি জেলা ও বরগুনা জেলা এবং পশ্চিমে বাগেরহাট জেলা ও সুন্দরবন অবস্থিত। পশ্চিমে বলেশ্বর নদী পিরোজপুরকে বাগেরহাটের থেকে আলাদা করেছে।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পিরোজপুর জেলার মোট জনসংখ্যা ১১,১৩,২৫৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৫,৪৮,২২৮ জন এবং মহিলা ৫,৬৫,০২৯ জন। মোট পরিবার ২,৫৬,০০২টি।
পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক মতে, ঋগবেদের আমলেও বঙ্গের দক্ষিণভাগ ছিল অতল সমুদ্রে নিমজ্জিত। মৌর্যযুগে পলল সংযোগে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ গড়ে ওঠলে ভূ-তাত্ত্বিকভাবে ক্রমশ পিরোজপুর ভূ-ভাগের পলল উত্থান ঘটে। পৌরাণিক নদী গঙ্গার পূর্বগামী শাখা নলিনী, হলদিনী, পাবনী নামে পরিচিত ছিল। পৌরাণিক নদীর উত্তরসূরী আধুনিক গঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, সুগন্ধার পলিরেণু গাঙ্গেয় বদ্বীপে যে সব দ্বীপ তথা নব্য ভূ-ভাগ সৃষ্টি করে, পিরোজপুর জেলার জনপদ সে সব দ্বীপেরই অংশবিশেষ। তবে জনপদ হিসেবে গড়ে ওঠেছে আরও পরে। ঐতিহাসিকদের ধারণায় পাল ও সেন আমলে বিচ্ছিন্নভাবে জনবসতি গড়ে উঠতে শুরু করলেও মূলত মোগল ও সুলতানি আমলে এ অঞ্চলে ব্যাপক জনবসতি গড়ে ওঠে। তবে উনিশ শতক পর্যন্ত পিরোজপুর জেলার একটি অংশ ছিল জলাশয়। এর মধ্যে স্বরূপকাঠির সাতলা, নাজিরপুরের বিল ও ভান্ডারিয়া অঞ্চলে চেচরি-রামপুর বিল অন্যতম।