পিরোজপুর একটি নদীমাতৃক জেলা। তার মধ্যে পিরোজপুর সদর অন্যতম। পিরোজপুর সদর উপজেলায় উল্লেখযোগ্য নদ-নদী হল কঁচা, বলেশ্বর, কালিগঙ্গা ও দামোদর। প্রাচীনকালে পিরোজপুর জেলার নদ-নদীর পানি লবনাক্ত ছিল। একসময় এ অঞ্চলে প্রচুর লবন উৎপন্ন হত। এ সদর উপজেলায় অসংখ্য খাল এবং দোন বিদ্যমান। দুই নদীর সংগে সংযোগকারী ছোট নদীকে দোন বা ভারানী বলে।
পিরোজপুর শহর বা পৌর এলাকা তথা পিরোজপুর থানার ভূ-ভাগকে দ্বিখন্ডিত করেছে এক সময়ের দামোদর নদী। বর্তমানে এ নদী খালে রুপ নিয়েছে। পিরোজপুর সদর উপজেলা বলেশ্বর ও দামোদর নদীর তীরে অবস্থিত। দামোদর বর্তমানে নামে আছে তবে প্রায় সম্পূর্ন ভরে গেছে। পিরোজপুর শহরের দুদিক দিয়েই বিশাল নদী প্রবাহিত হচ্ছে। শহরের পশ্চিম দিকে বলেশ্বর নদী, শহরের পূর্ব দিকে কালিগঙ্গা ও কঁচা নদী। বলেশ্বর নদী ও কালের বির্বতনে তার নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে।
মধুমতি নদী ভিন্ন ভিন্ন নামে পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলায় বলেশ্বর নাম হয়ে পিরোজপুর সদরের পশ্চিম পাশ ঘেষে দক্ষিনে প্রবাহিত হয়ে জিয়ানগর (টগড়া) কঁচা নদীতে মিলিত হয়েছে। মধুমতির আর একটি শাখা নদী কালিগঙ্গা নাজিরপুর হয়ে পিরোজপুর সদরের উত্তর ও পূর্ব পাশ ঘেষে দক্ষিন দিকে প্রবাহিত হয়ে পিরোজপুর সদরের নদী বন্দর হুলারহাটের নিকট কঁচা নদীতে মিলিত হয়েছে। এই কঁচা নদী হুলারহাট হয়ে পিরোজপুর সদরের পূর্ব পাশ ঘেষে দক্ষিন দিকে প্রবাহিত হয়ে জিয়া নগরে বলেশ্বর নদীর সাথে মিলিত হয়েছে এবং বলেশ্বর নদী জিয়ানগর থেকে দক্ষিন দিকে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে।
হুলারহাটের দিক থেকে যে কঁচা নদী প্রবাহিত হয়েছে এ নদী খুব চওড়া ও গভীর। এ নদী দিয়ে বর্তমানে বড় বড় লঞ্চ, ষ্টিমার চলে।
কালিগঙ্গা ও বলেশ্বরকে যুক্ত করেছে দামোদর যা পিরোজপুর শহরের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত। একসময় এই খাল ছিল প্রশস্ত একটি নদী, জাহাজ চলাচল করত। এটিকে চলতি ভাষায় বলা হয় ভারানী খাল। এই খালটির বিশেষত্ব হল- দুটি বড় নদীকে যুক্ত করেছে বলে একই সময় দু দিক দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে আবার একই সময় দু দিক থেকে বের হয়ে যায়। এই দামোদর খাল থেকে আবার সরু চারটি খাল শাখা বিস্তার করেছে। দুটি গেছে দক্ষিণ দিকে আর দুটি গেছে উত্তর দিকে। দক্ষিণ দিকের একটি পিরোজপুর শহর ভেদ করে নড়াইলপাড়া, মাছিমপুর, মাইটভাঙ্গা, পাড়েরহাট হয়ে বলেশ্বরে মিলেছে, অপরটি ধুপপাশা থেকে রানিপুর হয়ে নলবুনিয়া দিয়ে কঁচায় মিলেছে। উত্তর দিকের একটি রাজারহাট, চিলা কদমতলার দিকে এবং অন্যটি মরক খোলার সামনে দিয়ে কুমারখালি, ঝাটকাঠি হয়ে রায়েরকাঠির দিকে গেছে। একটি মিলেছে কালীগঙ্গায় অন্যটি বলেশ্বরে।
পিরোজপুর জেলা শহরের প্রবেশ পথ হুলারহাট লঞ্চঘাট বা বন্দর কালীগঙ্গা নদীর পাড়ে অবস্থিত। পিরোজপুর সদরের প্রায় প্রতিটি গ্রামে ২/৩টি করে খাল রয়েছে। এদের মধ্যে অনেক খালকেই বর্ষাকাল ছাড়া সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়না। অতীতে ছোট ছোট নদী ও খাল পশ্চিম মুখে প্রবাহিত হয়ে বড় বড় নদীগুলোকে সংযুক্ত করেছিল। বর্তমানে স্রোতের অভাবে দোনগুলোতে চর পড়েছে, এমনকি নৌকা চলাচলের অবস্থা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে। পিরোজপুর জেলায় এরকম কয়েকটি দোন রয়েছে। কঁচা ও বলেশ্বরকে যুক্ত করেছে দামোদর দোন (কলকাতা-বরিশাল স্টিমার চলাচলের পথ ছিল)।
অসংখ্য নদ-নদী, খাল-বিল দ্বারা বেষ্টিত। নদ-নদীতে দিনরাত ২৪ ঘন্টায় দু’বার জোয়ার-ভাটা হয়। জোয়ার-ভাটার স্থায়ীত্বকাল প্রতিবারে ৬ ঘন্টা। পিরোজপুর অঞ্চলে বর্ষাকালীন সময়ে জোয়ারের বেগে ১০-১৫ ফুট পানির স্ফীতি পরিচালিত হয়। এছাড়া অন্যান্য সময় জোয়ারে ৩ থেকে ৪ ফুট পানি বৃদ্ধি পায়। বর্ষাকালে এ অঞ্চলের জোয়ার- ভাটার বেগ এবং স্থায়ীত্বের সময় দীর্ঘায়িত হয়। নিম্ন অঞ্চল আষাঢ় মাস থেকে অক্টোবর পর্যন্ত জলমগ্ন থাকে। প্রাচীন নদীগুলো সংকুচিত হয়ে বহু সংখ্যক বিলের সৃষ্টি হয়েছে, আবার অনেক নদনদীতে পলি পড়ে খালের সৃষ্টি হয়েছে। এ উপজেলায় ডাকাতিয়া বিল উল্লেখযোগ্য।
পিরোজপুর জেলা নারিকেল, সুপারি, পেয়ারা, আমড়া এর জন্য বিখ্যাত।
প্রবাদ প্রবচন ও বিয়ের গানের জন্য পিরোজপুর বিখ্যাত। বর্তমানে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, দিশারী শিল্পী গোষ্ঠী,সংগীতা, ধ্বনি শিল্পী গোষ্ঠী, রুপান্তর নাট্য গোষ্ঠী, পিরোজপুর থিয়েটার, কৃষ্ণচুড়া থিয়েটার, বলাকা নাট্যম্ প্রভৃতি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী আঞ্চলিক ঐতিহ্য লালন পালন ও প্রচারে একাগ্র প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুর ছিল মুক্তিযুদ্ধের নবম সেক্টরের অধীন সুন্দরবন সাব-সেক্টর মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ এর কমান্ডের আওতায়।
পিরোজপুরের উত্তরে বরিশাল জেলা ও গোপালগঞ্জ জেলা, দক্ষিণে বরগুনা জেলা, পূর্বে ঝালকাঠি জেলা ও বরগুনা জেলা এবং পশ্চিমে বাগেরহাট জেলা ও সুন্দরবন অবস্থিত। পশ্চিমে বলেশ্বর নদী পিরোজপুরকে বাগেরহাটের থেকে আলাদা করেছে।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পিরোজপুর জেলার মোট জনসংখ্যা ১১,১৩,২৫৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৫,৪৮,২২৮ জন এবং মহিলা ৫,৬৫,০২৯ জন। মোট পরিবার ২,৫৬,০০২টি।
পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক মতে, ঋগবেদের আমলেও বঙ্গের দক্ষিণভাগ ছিল অতল সমুদ্রে নিমজ্জিত। মৌর্যযুগে পলল সংযোগে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ গড়ে ওঠলে ভূ-তাত্ত্বিকভাবে ক্রমশ পিরোজপুর ভূ-ভাগের পলল উত্থান ঘটে। পৌরাণিক নদী গঙ্গার পূর্বগামী শাখা নলিনী, হলদিনী, পাবনী নামে পরিচিত ছিল। পৌরাণিক নদীর উত্তরসূরী আধুনিক গঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, সুগন্ধার পলিরেণু গাঙ্গেয় বদ্বীপে যে সব দ্বীপ তথা নব্য ভূ-ভাগ সৃষ্টি করে, পিরোজপুর জেলার জনপদ সে সব দ্বীপেরই অংশবিশেষ। তবে জনপদ হিসেবে গড়ে ওঠেছে আরও পরে। ঐতিহাসিকদের ধারণায় পাল ও সেন আমলে বিচ্ছিন্নভাবে জনবসতি গড়ে উঠতে শুরু করলেও মূলত মোগল ও সুলতানি আমলে এ অঞ্চলে ব্যাপক জনবসতি গড়ে ওঠে। তবে উনিশ শতক পর্যন্ত পিরোজপুর জেলার একটি অংশ ছিল জলাশয়। এর মধ্যে স্বরূপকাঠির সাতলা, নাজিরপুরের বিল ও ভান্ডারিয়া অঞ্চলে চেচরি-রামপুর বিল অন্যতম।