পিরোজপুর নাম কবে কিভাবে কিসের ভিত্তিতে নিরুপিত বা নির্দিষ্ট হয়েছে তার কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য বা ইতিহাস জানা যায়নি। তবে অধিকাংশ অনুসন্ধান বা ইতিহাস গবেষনালব্ধ উপসংহারে অনুমিত হয়েছে যে, ফিরোজ নামের কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের নামকে স্মৃতিময় করে রাখার প্রয়াসে এই জায়গার নাম ফিরোজপুর হয়েছিল। দক্ষিনাঞ্চলের মানুষের আঞ্চলিক কথ্য ভাষার উচ্চারণগত বিচ্যুতিতে এক সময়ের ফিরোজপুর পিরোজপুর নামে প্রবর্তিত হয়ে গেছে।
পিরোজপুর সদর ছিল একটি গ্রাম মাত্র। যা টেগরা থানার অন্তর্গত ছিল। দামোদর নদের দক্ষিণ পাড় চরভুমি, আবাদি জমি ও বিক্ষিপ্ত জনবসতির মধ্যেই ১৮৬৫ সাল থেকে শহর নির্মানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় এবং সরকারী ভবন, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল, থানা প্রভৃতি নির্মিত হতে থাকে। গড়ে উঠতে থাকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দোকানপাঠ।
১৭৯০ সনে বাখরগঞ্জে ১০টি থানা স্থাপিত হয়। যার একটি পিরোজপুর সদরের পাড়েরহাট নিকটবর্তী টগরা গ্রামে টগরা থানা। ১৮৫৯ সালে পিরোজপুর মহকুমা ঘোষিত হলে টগরা থেকে থানা স্থানান্তর হয় মহকুমা সদরে এবং পিরোজপুর থানা হিসেবে নামকরণ করা হয়। তখন পিরোজপুর থানার আওতাধীন ৮টি ইউনিয়ন (শিকদারমল্লিক, কদমতলা, দুর্গাপুর, কলাখালী, টোনা, শারিকতলা, শংকরপাশা ও পাড়েরহাট) ছিল। ১৯৮৪ সনে মহকুমাকে জেলায় রুপান্তরিত করার প্রক্রিয়ায় পিরোজপুর মহকুমাকে জেলা করা হয় এবং পিরোজপুর ও ইন্দুরকানি থানা সমন্বয়ে পিরোজপুর সদর উপজেলা করা হয়। যাতে পত্তাশী ও বালিপাড়া ইউনিয়ন অর্ন্তভুক্ত হয়ে ইউনিয়নের সংখ্যা হয় ১০টি। পরবর্তীতে সরকার ২০০২ সালে পাড়েরহাট, পত্তাশী ও বালিপাড়া ইউনিয়ন সমন্বয়ে জিয়ানগর উপজেলা নামে একটি নতুন উপজেলা সৃষ্টি করে। সে প্রেক্ষিতে বর্তমানে পিরোজপুর সদর উপজেলার ইউনিয়নের সংখ্যা ৭টি (শিকদারমল্লিক, কদমতলা, দুর্গাপুর, কলাখালী, টোনা, শারিকতলা ও শংকরপাশা)।
পিরোজপুর সদর উপজেলা ২২°৩০' উত্তর থেকে ২২°৪২' উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯°৫৪' পূর্ব থেকে ৯০°২০' পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। এর পূর্ব দিকে কচা ও কালীগঙ্গা নদী সংযুক্ত কাউখালী ও ভান্ডারিয়া উপজেলা, পশ্চিম দিকে বাগেরহাট জেলার মোড়েলগঞ্জ ও কচুয়া উপজেলা, উত্তর দিকে নাজিরপুর এবং দক্ষিন দিকে জিয়ানগর উপজেলা অবস্থিত।
পিরোজপুর জেলা নারিকেল, সুপারি, পেয়ারা, আমড়া এর জন্য বিখ্যাত।
প্রবাদ প্রবচন ও বিয়ের গানের জন্য পিরোজপুর বিখ্যাত। বর্তমানে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, দিশারী শিল্পী গোষ্ঠী,সংগীতা, ধ্বনি শিল্পী গোষ্ঠী, রুপান্তর নাট্য গোষ্ঠী, পিরোজপুর থিয়েটার, কৃষ্ণচুড়া থিয়েটার, বলাকা নাট্যম্ প্রভৃতি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী আঞ্চলিক ঐতিহ্য লালন পালন ও প্রচারে একাগ্র প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুর ছিল মুক্তিযুদ্ধের নবম সেক্টরের অধীন সুন্দরবন সাব-সেক্টর মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ এর কমান্ডের আওতায়।
পিরোজপুরের উত্তরে বরিশাল জেলা ও গোপালগঞ্জ জেলা, দক্ষিণে বরগুনা জেলা, পূর্বে ঝালকাঠি জেলা ও বরগুনা জেলা এবং পশ্চিমে বাগেরহাট জেলা ও সুন্দরবন অবস্থিত। পশ্চিমে বলেশ্বর নদী পিরোজপুরকে বাগেরহাটের থেকে আলাদা করেছে।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পিরোজপুর জেলার মোট জনসংখ্যা ১১,১৩,২৫৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৫,৪৮,২২৮ জন এবং মহিলা ৫,৬৫,০২৯ জন। মোট পরিবার ২,৫৬,০০২টি।
পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক মতে, ঋগবেদের আমলেও বঙ্গের দক্ষিণভাগ ছিল অতল সমুদ্রে নিমজ্জিত। মৌর্যযুগে পলল সংযোগে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ গড়ে ওঠলে ভূ-তাত্ত্বিকভাবে ক্রমশ পিরোজপুর ভূ-ভাগের পলল উত্থান ঘটে। পৌরাণিক নদী গঙ্গার পূর্বগামী শাখা নলিনী, হলদিনী, পাবনী নামে পরিচিত ছিল। পৌরাণিক নদীর উত্তরসূরী আধুনিক গঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, সুগন্ধার পলিরেণু গাঙ্গেয় বদ্বীপে যে সব দ্বীপ তথা নব্য ভূ-ভাগ সৃষ্টি করে, পিরোজপুর জেলার জনপদ সে সব দ্বীপেরই অংশবিশেষ। তবে জনপদ হিসেবে গড়ে ওঠেছে আরও পরে। ঐতিহাসিকদের ধারণায় পাল ও সেন আমলে বিচ্ছিন্নভাবে জনবসতি গড়ে উঠতে শুরু করলেও মূলত মোগল ও সুলতানি আমলে এ অঞ্চলে ব্যাপক জনবসতি গড়ে ওঠে। তবে উনিশ শতক পর্যন্ত পিরোজপুর জেলার একটি অংশ ছিল জলাশয়। এর মধ্যে স্বরূপকাঠির সাতলা, নাজিরপুরের বিল ও ভান্ডারিয়া অঞ্চলে চেচরি-রামপুর বিল অন্যতম।