মান্দা, নওগাঁ ও পাঁচপুর এই তিন থানা নিয়ে ১৮৭৭ সালে নওগাঁ মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৭৫ সালে নওগাঁ বান্দাইখাড়া থানাধীন নদী বন্দর ছিল। মহকুমা সদর নির্বাচিত হবার পূর্বেই থানা বান্দাইখাড়া থেকে নওগাঁয় স্থানান্তরিত হয়। পূর্বে বান্দাইখাড়া ও মান্দা থানা রাজশাহী সদর মহকুমার অন্তর্ভুক্ত ছিল। নওগাঁ মহকুমা প্রতিষ্ঠা হবার আগে থেকে বান্দাইখাড়া থানায় একটি মুন্সেফ (ফৌজদারি মামলার বিচারক) চৌকি প্রতিষ্ঠিত ছিল। ১৯৩২ সালে প্রকাশিত একটি পুস্তিকা থেকে জানা যায়, নওগাঁর প্রাচীন আদিবাসী তরফদারগন ৪০০ বছর আগে আজমীর (মতান্তরে বাগদাদ) থেকে আসেন। মুর্শিদাবাদের নাবাব সরকার ‘তরফদার’ খেতাব দেন। নওগাঁয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুমারখালি কুঠির তত্তবধানে একটি কারখানা ছিল। ১৮৩৪ সালে নওগাঁ দুবলহাটি থানার অধীন। সুলতানপুর, দুপচাঁচিয়া ও নওগাঁ দুবলহাটি জমিদারের অন্তর্গত ছিল।
১৭৯৩ সালে ঘোড়াঘাট অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮২১ সালে বদলগাছী থানা বগুড়া জেলার অন্তর্গত হয়। ১৮৯৬-৯৭ সালে বগুড়া জেলার অন্তর্ভুক্ত বদলগাছী থানাকে স্থানান্তরিত করে রাজশাহী জেলার নওগাঁ মহকুমার সাথে সংযুক্ত করা হয়। ১৯৮৩ সালের ৭ নভেম্বর প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ফলে বদলগাছী থানাকে বদলগাছী উপজেলা হিসেবে রূপান্তরিত হয়। ১৯৮৪ সালের পহেলা মার্চ নওগাঁ জেলার উদ্বোধন হয় এবং বদলগাছীকে নওগাঁ জেলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বদলগাছী নামকরণের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, মুদ্রা ব্যবস্থা প্রচলনের পূর্বে, দ্রব্য বিনিময় ব্যবস্থার আমলে মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী বদলগাছী নামক স্থানে বিনিময় করত। দ্রব্য বদলা-বদলীর স্থান হিসেবে কালক্রমে এর নাম হয়েছে বদলগাছী।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ২২ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী নওগাঁ দখল করে। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে প্রতিহত ও পরাভূত করার লক্ষ্যে আতোয়ার রাহমান তালুকদারকে (এমএনএ) বদলগাছী থানার দায়িত্ব দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৫ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ জালাল হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে বদলগাছী থানার কোলা ভান্ডারপুর নামক স্থানে মুক্তি বাহিনী ও পাক বাহিনীর মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধে অসংখ্য পাকসেনা এবং দুইজন মুক্তিযোদ্ধা মারা যান।
এছাড়া কোলা, ভান্ডারপুর, মিঠাপুর, বালুভরা নামক এলাকায় পাকসেনারা অনেক ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং বহুলোককে হত্যা করে। এছাড়াও সোমপুর বিহারের পাহাড়পুর গ্রামের সন্নিকটে হানাদার বাহিনী গণহত্যা সংঘটিত করে। ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর বদলগাছীকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করা হয়।
নওগাঁ জেলা চাল এবং সন্দেশ এর জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও কসুম্বা মসজিদ এবং রঘুনাথ মন্দির এই দুটি স্থান এর জন্য বিখ্যাত।
নওগাঁ জেলার বিখ্যাত খাবার ‘প্যারা সন্দেশ’নওগাঁর ঐতিহ্যবাহী ‘প্যারা’ সন্দেশের সুখ্যাতি এখন বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে বিদেশেও। শুরুতে পূজা মণ্ডপের দেব-দেবীর উপাসনার উদ্দেশে এই সন্দেশ তৈরি করা হলেও সময়ের স্রোতে এখন তা অতিথি আপ্যায়ন, আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে পাঠানো বা নিয়ে যাওয়া মর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি কেজি সন্দেসের মূল্য ৩০০ টাকা। নওগাঁর এই ঐতিহ্যবাহী সন্দেশ এখন দেশের বাইরেও বেশ সুনাম অর্জন করছে।
কবে থেকে নওগাঁর ‘প্যারা’ সন্দেশের প্রচলন শুরু হয়েছে তা সুস্পষ্টভাবে জানা না গেলেও সংশ্লিষ্টদের ও গবেষকদের ধারণা মতে, নওগাঁয় প্রায় একশ’ বছরের অধিক কাল আগে থেকে প্যারা সন্দেশ তৈরী হয়ে আসছে। জানা গেছে, শহরের কালীতলা এলাকায় শ্রী শ্রী বুড়ী কালী মাতা মন্দিরের কাছে শত বছর আগে থেকে এই ‘প্যারা’ সন্দেশ তৈরী হয়ে আসছে। এই সন্দেশ পূজারীরা পূজা মন্ডপের দেবদেবীর উপাসনায় ভোগ দিয়ে থাকনে।
নওগাঁ শহরের কালীতলা পূজা মণ্ডপের প্রধান গেট সংলগ্ন এলাকায় ছোট ছোট কয়েকটি মিষ্টান্নের দোকান রয়েছে। এগুলোকে বলা হয় ভোগের দোকান। দেবীর আরাধনায় মিষ্টান্নর প্রয়োজনেই প্রায় শত বছর আগে এই দোকানিরাই প্রথম তৈরি করেন বিখ্যাত প্যারা সন্দেশ। কিন্তু পরবর্তীতে এই সন্দেশ শুধু দেবীর আরাধনার মধ্যেই সীমাবন্ধ থাকেনি।
সুস্বাদু আর পুষ্টিগুনের কারণে এই সন্দেশ এখন বিখ্যাত। জানা যায়, হিন্দু সম্প্রদায়ের ভক্তগণ প্রায় সারা বছরই বিভিন্ন পূজা-অর্চনা করতে এখানে আসেন এবং পূজারীরা মন্দিরে ভোগ দিয়ে থাকেন। এই ভোগের প্রয়োজন মেটাতে শহরের কালীতলায় শত বছর আগে ছোট ছোট মিষ্টির দোকান গড়ে ওঠে। এসব দোকান থেকে প্রয়োজনীয় মিষ্টি জাতীয় দ্রব্যাদি কিনে নিয়ে পূজারীরা মন্ডপে দেবীর অর্ঘ্য হিসেবে ভোগ দিয়ে থাকেন।
জনশ্রুতি রয়েছে, ভারতের বিহারের কোনো এক নবাবের মিষ্টি তৈরির কারিগর ছিলেন মহেন্দ্রী দাস। নবাব এক যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হওয়ার পর ওই ব্যক্তি প্রাণ ভয়ে নওগাঁ শহরের কালীতলা্ এলাকায় বসতি গড়ে জীবিকার তাগিদে ‘প্যারা’ সন্দেশ তৈরি করে মন্দিরে বিক্রি শুরু করেন। পরে সেখানেই ছোট্ট একটা মিষ্টির দোকান খুলে বসেন। শত বছর আগে তখন কালীতলা এলাকায় জনবসতি ছিল না বললেই চলে। মহেন্দ্রীর মৃত্যুর পর তার ছেলে ধীরেন্দ্রনাথ দাস দোকানের দায়িত্ব নেন।
সেই সময় বিমল মহন্ত নামে মিষ্টি তৈরির এক কারিগরের হাতের স্পর্শে ‘প্যারা’ সন্দেশের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। জানা গেছে, ভারত, কুয়েত, সৌদি আরব, তুরস্ক, মালয়েশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের ক্রেতারা এখান তেকে প্যারা সন্দেশ নিয়ে যাচ্ছেন। পুষ্টিগুণ আর স্বাদ ও মানের দিক থেকে এই প্যারা সন্দেশ অতুলনীয়।’
নওগাঁ জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। উপজেলার সংখ্যানুসারে নওগাঁ বাংলাদেশের একটি “এ” শ্রেণীভুক্ত জেলা।[২] নওগাঁ জেলা ভৌগোলিকভাবে বৃহত্তর বরেন্দ্র ভূমির অংশ। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমভাগে বাংলাদেশ-ভারত আন্তর্জাতিক সীমারেখা সংলগ্ন যে ভূখণ্ডটি ১৯৮৪ সালের ১লা মার্চের আগ পর্যন্ত নওগাঁ মহকুমা হিসেবে গণ্য হতো, তা-ই হয়েছে বর্তমান বাংলাদেশের নওগাঁ জেলা।
নওগাঁ শব্দর উৎপত্তি হয়েছে ‘নও’ (নতুন -ফরাসী শব্দ ) ও‘ গাঁ’ (গ্রাম ) শব্দ দু’টি হতে। এই শব্দ দু’টির অর্থ হলো নতুন গ্রাম। অসংখ্য ছোট ছোট নদীর লীলাক্ষেত্র এ অঞ্চল। আত্রাই নদী তীরবর্তী এলাকায় নদী বন্দর এলাকা ঘিরে নতুন যে গ্রাম গড়ে উঠে, কালক্রমে তা-ই নওগাঁ শহর এবং সর্বশেষ নওগাঁ জেলায় রুপান্তরিত হয়। নওগাঁ শহর ছিল রাজশাহী জেলার অন্তর্গত। কালক্রমে এ এলাকাটি গ্রাম থেকে থানা এবং থানা থেকে মহকুমায় রুপ নেয়। ১৯৮৪ এর ১ মার্চ- এ নওগাঁ মহকুমা ১১টি উপজেলা নিয়ে জেলা হিসেবে ঘোষিত হয়।
বাংলাদেশ উত্তর -পশ্চিমভাগ বাংলাদেশ - ভারত আন্তর্জাতিক সীমা রেখা সংলগ্ন যে ভূখন্ডটি ১৯৮৪ খ্রিঃ এর ১ মার্চের পূর্ব পর্যন্ত অবিভক্ত রাজশাহী জেলার অধীন নওগাঁ মহকুমা হিসেবে গণ্য হতো, তাই এখন হয়েছে নওগাঁ জেলা। নওগাঁ প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন ভূক্ত অঞ্চল ছিল। অন্য দিকে এটি আবার বরেন্দ্র ভূমিরও একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ । নওগাঁর অধিবাসীরা ছিল প্রাচীন পুণ্ড্র জাতির বংশধর। নৃতাত্ত্বিকদের মতে, পুন্ড্ররা বিশ্বামিত্রের বংশধর এবং বৈদিক যুগের মানুষ। মহাভারত্র পুণ্ড্রদের অন্ধ ঋষি দীর্ঘতমার ঔরষজাত বলি রাজার বংশধর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার কারো মতে, বাংলার আদিম পাদদর বংশধর রুপে পুন্ড্রদের বলা হয়েছে। এদিক দিয়ে বিচার করলে নওগাঁ যে প্রাচীন জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল ছিল তা সহজেই বলা যায়।
নওগাঁ জেলায় আদিকাল হতেই বৈচিত্রে ভরপুর। ছোট ছোট নদী বহুল এ জেলা প্রাচীনকাল হতেই কৃষি কাজের জন্য প্রসিদ্ধ। কৃষি কাজের জন্য অত্যন্ত উপযোগী এলাকার বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ে অসংখ্য জমিদার গোষ্ঠী গড়ে উঠে। এ জমিদার গোষ্ঠীর আশ্রয়েই কৃষি কাজ সহযোগী হিসেবে খ্যাত সাঁওতাল গোষ্ঠীর আগমন ঘটতে শুরু করে এ অঞ্চলে। সাঁওতাল গোষ্ঠীর মতে এ জেলায় বসবাসরত অন্যান্য আদিবাসীদের মধ্যে মাল পাহাড়িয়া, কুর্মি, মহালী ও মুন্ডা বিশেষভাবে খ্যাত। নানা জাতি ও নানা ধর্মের মানুষের সমন্বয়ে গঠিত নওগাঁ জেলা মানব বৈচিত্র্যে ভরপুর। অসংখ্য পুরাতন মসজিদ, মন্দির, গীর্জা ও জমিদার বাড়ি প্রমাণ করে নওগাঁ জেলার সভ্যতার ইতিহাস অনেক পুরাতন।