‘ক্রীড়াই শক্তি’’-প্রবচনটি একটি সুশৃঙখল সমাজের জন্য অত্যন্ত যথার্থ। ক্রীড়া যেমন একটি সমাজের বহুমুখী সামর্থের পরিচায়ক একই সাথে তা একটি জনগোষ্ঠীর শৃঙখলা ও সম্প্রীতিরও পরিচায়ক বটে। ক্রীড়া আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে। ক্রীড়া আমাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রেরণা যোগায়। ক্রীড়া আমাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্য দৃঢ়মূল করে।
বান্দরবান পার্বত্য জেলা অনেক বৈশিষ্ট্যেই একটি অনন্য সাধারণ জেলা। প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের ন্যায় এর অধিবাসীদের ক্রীড়ায় কৃতিত্বও বেশ উল্লেখযোগ্য। বান্দরবান বাংলাদেশের একটি অন্যতম বৃহৎ জেলা হলেও এর জনসংখ্যা তুলনামূলক উল্লেখযোগ্য নয়। তথাপি ইতোমধ্যে এ জেলার ক্রীড়াবিদরা বিভিন্ন ক্রীড়া নৈপুণ্য প্রদর্শনে যে সামর্থ দেখিয়েছেন তা অত্যন্ত প্রশংসার দাবি রাখে। শুধুমাত্র জাতীয় পর্যায়ে নয় আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বান্দরবানের ক্রীড়াবিদদের বিশেষ সাফল্য রয়েছে। ১১তম এসএ গেমস্ কারাতে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ জাতীয় দলের স্বর্ণ জয় করেন জ উ প্রু ও উচাইনু। জাতীয় পর্যায়ে জ উ প্রু কারাতে প্রতিযোগিতায় ১৫ বার পদক অর্জন করেন। ব্যক্তিগত ইভেন্টে তিনি এসএ গেইমসে্ মোট ৫টি স্বর্ণ পদক অর্জন করেন। বান্দরবানের আরেকজন এথলেট মাথুইপ্রু আর্চারিতে এস.এ গেইমসে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। বান্দরবানের মোহন খান বাংলাদেশ গেইমসে পরপর তিনবার দ্রুততম মানব হওয়ার স্বীকৃতি অর্জন করেন। এস এ গেইমসে্ কারাতে প্রতিযোগিতায় লামার মেয়ে ইতি ইসলাম ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। বান্দরবানের লামা উপজেলায় অবস্থিত কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজ-এর শিক্ষার্থীরা ৪৩তম জাতীয় স্কুল ও মাদ্রাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ২০১৪-এ হ্যান্ডবল প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। বান্দরবানের মেয়ে তিং তিং ম্যা জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় তিনবার স্বর্ণ পদক অর্জন করেন। জাতীয় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতায় বান্দরবান মহিলা ক্রীড়া দল তিনবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। জাতীয় পর্যায়ে জুনিয়র খো খো প্রতিযোগিতায় বান্দরবান জেলা দল অংশগ্রহণ করে তৃতীয় স্থান অর্জন করে। ২০১২-তে রাঙামাটিতে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার গোল্ড কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে বান্দরবান ফুটবল দল রানার্স আপ হওয়ার গৌরব অর্জন করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতায় বান্দরবান ব্যাডমিন্টন দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। আন্তঃ জেলা ভলিবল টুর্নামেন্টে বান্দরবান চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। ঢাকায় মাওলানা ভাসানি হকি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত জাতীয় উপজাতি হকি প্রতিযোগিতায় বান্দরবান হকি দল পরপর তিনবার রানার্স আপ হওয়ার গৌরব অর্জন করে। বান্দরবানের ছেলে মোঃ জসিম উদ্দিন বাংলাদেশ অনুর্দ্ধ ২৩ জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্ব করার মর্যাদা লাভ করেছেন। বান্দরবান থেকে প্রেরিত ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, টেবিলটেনিস, নৌকা বাইচ, এথলেটিক্সসহ বিভিন্ন ক্রীড়া ইভেন্টে দলসমূহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ট্রফি ও চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
বান্দরবান জেলা বাংলাদেশের সবচেয়ে কম জনবসতিপূর্ণ জেলা। ২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এ জেলার মোট জনসংখ্যা ৪,৮০,৬৪২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২,৪৬,৫৯০ জন এবং মহিলা ২,৩৪,০৩৫ জন। মোট পরিবার ৮০,১০২টি। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১০৭জন।
বান্দরবানের ধর্মবিশ্বাস-২০২২
ইসলাম (৫২.৬৮%)
বৌদ্ধ (২৯.৫২%)
খ্রিস্ট ধর্ম (৯.৭৮%)
হিন্দু ধর্ম (৩.৪২%)
ধর্মবিশ্বাস অনুসারে এ জেলার মোট জনসংখ্যার৫২.৬৮ মুসলিম, ৩.৪২ হিন্দু, ২৯.৫২ বৌদ্ধ এবং ৯.৭৮ খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। মুসলিম ও হিন্দুরা বাংলাভাষী। এছাড়াও এ জেলায় মারমা, চাকমা, চাক, বম, মুরং, ত্রিপুরা, খেয়াং, খুমি, লুসাই প্রভৃতি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে ২১°১১´ থেকে ২২°২২´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯২°০৪´ থেকে ৯২°৪১´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ জুড়ে বান্দরবান জেলার অবস্থান। রাজধানী ঢাকা থেকে এ জেলার দূরত্ব প্রায় ৩২৫ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম বিভাগীয় সদর থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার। এ জেলার পশ্চিমে কক্সবাজার জেলা ও চট্টগ্রাম জেলা, উত্তরে রাঙ্গামাটি জেলা, পূর্বে রাঙ্গামাটি জেলা ও মায়ানমারের চিন প্রদেশ এবং দক্ষিণে ও পশ্চিমে মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ অবস্থিত।
বান্দরবান জেলার নামকরণ নিয়ে একটি কিংবদন্তি রয়েছে। এলাকার বাসিন্দাদের প্রচলিত রূপ কথায় আছে অত্র এলাকায় একসময় বাস করত অসংখ্য বানর । আর এই বানরগুলো শহরের প্রবেশ মুখে ছড়ার পাড়ে পাহাড়ে প্রতিনিয়ত লবণ খেতে আসত। এক সময় অনবরত বৃষ্টির কারণে ছড়ার পানি বৃ্দ্ধি পাওয়ায় বানরের দল ছড়া পাড় হয়ে পাহাড়ে যেতে না পারায় একে অপরকে ধরে ধরে সারিবদ্ধভাবে ছড়া পাড় হয়। বানরের ছড়া পারাপারের এই দৃশ্য দেখতে পায় এই জনপদের মানুষ। এই সময় থেকে এই জায়গাটির পরিচিতি লাভ করে "ম্যাঅকছি ছড়া " হিসাবে । অর্থ্যাৎ মার্মা ভাষায় ম্যাঅক অর্থ বানর আর ছিঃ অর্থ বাঁধ । কালের প্রবাহে বাংলা ভাষাভাষির সাধারণ উচ্চারণে এই এলাকার নাম রুপ লাভ করে বান্দরবান হিসাবে । বর্তমানে সরকারি দলিল পত্রে বান্দরবান হিসাবে এই জেলার নাম স্থায়ী রুপ লাভ করেছে। তবে মার্মা ভাষায় বান্দরবানের নাম "রদ ক্যওচি ম্রো"।
বৃটিশ শাসন আমলে ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে জেলা ঘোষণা করা হয়। তৎকালীন সময়ে বান্দরবান পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার অধীন ছিলো। ক্যাপ্টেন মাগ্রেথ ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার প্রথম সুপারিনট্যানডেন্ট। ১৮৬৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার সুপারিনট্যানডেন্ট পদটির কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করা হয় এবং ১৮৬৭ সালে এই পদটির নামকরণ করা হয় ডেপুটি কমিশনার। পার্বত্য চট্ট্রগাম জেলার প্রথাম ডেপুটি কমিশনার ছিলেন টি, এইচ লুইন। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করা হয়-চাকমা সার্কেল, মং সার্কেল, এবং বোমাং সার্কেল। প্রত্যেক সার্কেলের জন্য একজন সার্কেল চীফ নিযুক্ত ছিলেন। বান্দরবান তৎকালীন সময়ে বোমাং সার্কেলের অর্ন্তভুক্ত ছিলো। বোমাং সার্কেলের অন্তর্ভূক্ত হওয়ার কারণে এই জেলার আদি নাম বোমাং থং।
বান্দরবান জেলা ১৯৫১ সালে মহকুমা হিসেবে প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু করে। এটি রাংগামাটি জেলার প্রশাসনিক ইউনিট ছিলো। পরর্বতীতে ১৯৮১ সালের ১৮ই এপ্রিল, তৎকালিন লামা মহকুমার ভৌগলিক ও প্রশাসনিক সীমানাসহ সাতটি উপজেলার সমন্বয়ে বান্দরবান পার্বত্য জেলা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।