The Ballpen
মুক্তিযুদ্ধে পিরোজপুর - theballpen

মুক্তিযুদ্ধে পিরোজপুর

25th Dec 2022 | পিরোজপুর জেলা |

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের প্রেক্ষিতে দেশের অন্যান্য স্থানের মত তৎকালীন পিরোজপুর মহকুমার প্রতিটি গ্রামে গড়ে ওঠে প্রতিরোধের দুর্গ। পিরোজপুর শহরতলীতে রায়েরকাঠী জমিদারবাড়ির পরিত্যক্ত ভবনে গড়ে ওঠে একটি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প। শত্রুর বিরুদ্ধে ৩ মার্চ বিকালে ঢাকা থেকে আগত সামসুল হক, ছাত্রলীগ নেতা ওমর ফারুক ও আওয়ামীলীগ নেতা বদিউল আলমের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের কর্মীরা পিরোজপুরে পাকিস্তানি পতাকায় অগ্নিসংযোগ করতে করতে মিছিল সহকারে শহর প্রদক্ষিণ করে। এর আগে ২মার্চ ছাত্র ইউনিয়ন শহরে বাঁশের লাঠি ও ডামি রাইফেল নিয়ে সদর রাস্তায় সকাল দিকে সুশৃঙ্খল মহড়া প্রদর্শন করলে পথচারী জনসাধারণ করতালি দিয়ে তাঁদের অভিনন্দন জানায়।

ছাত্রলীগ নেতা ওমর ফারুক ২৩ মার্চ শত শত জনতার উপস্থিতিতে স্থানীয় টাউন হল মাঠের শহীদ মিনারে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উড়িয়ে দেন। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বরিশাল থেকে নূরুল ইসলাম মঞ্জুর টেলিফোনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা পিরোজপুরে পাঠান। এসময় পিরোজপুরে আওয়ামীলীগের নির্বাচিত এম.এন.এ (মেম্বর অব ন্যাশনাল এসেম্বলি) ছিলেন এ্যাডভোকেট এনায়েত হোসেন খান। ২৬ মার্চ বিকেলে পিরোজপুর টাউনহল ময়দানের জনসভায় অস্ত্র সংগ্রহের আহবান জানালে এ্যাডভোকেট এনয়েত হোসেন খান, ডাঃ আব্দুল হাই, ডাঃ ক্ষিতীষ চন্দ্র মন্ডল, এ্যাডভোকেট আলী হায়দার খান, স্বরূপকাঠির জাহাঙ্গীর বাহাদুর, ফজলুল হক খোকন, জামালুল হক মনু প্রমূখ স্বাধীনাতা প্রেমী জনতা টাউন হলের অদূরে পিরোজপুর মহকুমা প্রশাসকের অফিস সংলগ্ন অস্ত্রাগারটি আক্রমণ করে সমস্ত রাইফেল, বুলেট সংগ্রহ করেন।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চে সংগ্রাম পরিষদের জনসভা চলছিল গোপাল কৃষ্ণ টাউন ক্লাব মাঠে। এই সভায় তদানীন্তর এম, এন,এ অ্যাডভোকেট এনায়েত হোসেন খান ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের নৃশংস, নির্মম হত্যাকান্ডের বিবরন দিয়ে ভাষন দেয়ার সময় স্বাধীনতাকামী উপস্থিত জনতা উত্তেজিত হয়ে ‘ অস্ত্র চাই অস্ত্র চাই’ ধ্বনি দিতে থাকলে তিনি জনতাকে আশ্বস্ত করে বলেন আজ এখনই অস্ত্রাগার লুন্ঠন করে তোমাদের হাতে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য অস্ত্র তুলে দেয়া হবে। বক্তব্য শেষ হওয়ার সাথে সাথে উত্তেজিত জনতা অস্ত্রাগারের দিকে এগিয়ে যায়। পিরোজপুরের মহকুমা প্রশাসকের অফিস সংলগ্ন অস্ত্রাগারটি লুণ্ঠনে নেতৃত্ব দেন অ্যাডভোকেট এনায়েত হোসেন খান, ডাঃ আব্দুল হাই, ডাঃ ক্ষিতীশ চন্দ্র মন্ডল, অ্যাডেভোকেট আলী হায়দার খান, জাহাঙ্গীর বাহাদুর, ফজলুল হক খোকন প্রমুখ। সুশৃংখলভাবে এখান থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। তারমধ্যে ৪২ টি রাইফেল হস্তগত করে নকশালপন্থীরা, ২২ টি বন্দুক চলে যায় শান্তি কমিটির হাতে। ২৮ মার্চ পিরোজপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এখানে সাধারণ মানুষদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ১৯ মে ১৯৭১ অস্ত্রাগারের আর.এস.আই. গোলাম মাওলা বাদী হয়ে পিরোজপুর থানায় ৫৫ জনকে আসামী করে এই ৫নং মামলা দায়ের করেন।

২১ মার্চ লাহোর থেকে পিরোজপুরে আসেন পিরোজপুরের সন্তান লেঃ জিয়াউদ্দিন। ২৭ মার্চ বিকাল ৪টা থেকে পিরোজপুর সরকারী হাইস্কুল মাঠে তাঁর প্রচেষ্টায় মুক্তিফৌজ গঠন পূর্বক অস্থায়ীভাবে গঠিত বিপ্লবী সরকারের স্থানীয় প্রধান এ্যাডভোকেট এনায়েত হোসেন খান এম.এন.এ-কে গার্ড অব অনার প্রদান করে। জনাব এনায়েত হোসেন খান (এ্যাডভোকেট), ডাঃ আঃ হাই, আলী হায়দার খান (এ্যাডভোকেট), ডাঃ ক্ষিতীশ চন্দ্র মন্ডল ও জাহাঙ্গীর বাহাদুর এই পাচ জন উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক  নেতা হিসাবে পিরোজপুর মহকুমার মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। ৪ মে পিরোজপুরে প্রথমে হানাদার পাকবাহিনী প্রবেশ করে। হুলারহাট বন্দরে প্রথম পাক-বাহিনীর গানবোট ভিড়ে ৩ মে ১৯৭১। ১৭ এপ্রিল নগর সরকার গঠন হওয়ার পর পিরোজপুর মহাকুমা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে পাকিস্তান সরকারের সাথে সর্বপ্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করে। এসময় পিরোজপুর স্কুল মাঠ ও কালেক্টরেট মাঠে মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা প্রশিক্ষণ নেয়। পুরোদমে চালু হয়ে গেলো স্বাধীন বাংলাদেশের সীল, তখন পিরোজপুর ট্রেজারি অফিসার সাইফ মিজানুর রহমান ট্রেজারীর অস্ত্র ও সমস্ত টাকা পয়সা তুলে দেন মুক্তি বাহিনীর হাতে।

পিরোজপুরে তখন এসডিও ছিলেন ফয়জুর রহমান। তিনি তার পুলিশ বাহিনী নিয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন পিরোজপুরের মুত্তিযোদ্ধাদের। হুলারহাট থেকে শহরে প্রবেশের পথে তারা মাছিমপুর আর কৃষ্ণনগর গ্রামে শুরু করে হত্যাযজ্ঞ। স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় হিন্দু আর স্বাধীনতার পক্ষের মুসলমানদের বাড়িঘরে দেয়া হয় আগুন, হত্যা করা হয় অসংখ্য মানুষ। ৫ মে ৭১ বলেশ্বর খেয়াঘাটে দাড় করিয়ে এক সঙ্গে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে তাদের লাশ ফেলে দেওয়া হয় বলেশ্বর নদীতে। বলেশ্বর নদীর পাড়ে পুরানো খেয়াঘাট ও তার আশেপাশের ঘাট ছিল হত্যাযজ্ঞের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। পিরোজপুরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বলেশ্বর খেয়াঘাটের গুরুত্ব অত্যধিক।  ৫ মে ৭১ বলেশ্বর খেয়াঘাটে গুলি করে হত্যা করা হয় তারমধ্যে যেসব শহীদদের নাম পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে শহীদ আঃ রাজ্জাক, শহীদ সাইফ মিজানুর রহমান ও শহীদ ফয়জর রহমান আহমেদও ছিলেন।

বলেশ্বর খেয়াঘাট বধ্যভূমিতে এরাই প্রথম হত্যাকান্ডের শিকার হন। ৬ মে রাজাকারদের সহায়তায় ধৃত পিরোজপুরের তৎকালীন এস.ডি.ও(ভারপ্রাপ্ত) আব্দুর রাজ্জাক, ম্যাজিস্ট্রেট সাইফ মিজানুর রহমান (নড়াইল), এস.ডি.পি.ও ফয়জুর আহমেদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পিরোজপুরের অদূরে চালিতাখালী গ্রাম থেকে এক দড়িতে বেধে আনা হয় মোসলেম আলী শেখ, আব্দুর রহমান সরদার, খাউলবুনিয়ার আব্দুল গফ্ফার মাস্টার, জলিল হাওলাদার, জুজখোলার সতীশ মাঝি এবং শামছু ফরাজীসহ ১২ জন স্বাধীনতাকামীকে। তাঁদেরকে বলেশ্বরের বধ্যভূমিতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর দুপুর ১২ টায় তৎকালীন পিরোজপুর মহকুমা শহর শত্রুমুক্ত হয় এবং সমাপ্তি ঘটে দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের। পিরোজপুরের ঘরে ঘরে উত্তোলিত হয় বিজয়ের পতাকা।

স্বাধীনতার পর পূর্বদেশ-এর প্রতিবেদনে বলা হয় বরিশালে পাকিস্তানি বাহিনী ৫০ হাজার লোককে হত্যা করে। পিরোজপুরে এ সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ হাজার। এই মহকুমায় প্রায় ১০ হাজার নারী-পুরুষ-শিশুকে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা হত্যা করে।





Related

পিরোজপুর জেলা কি জন্য বিখ্যাত?

 পিরোজপুর জেলা নারিকেল, সুপারি, পেয়ারা, আমড়া এর জন্য বিখ্যাত।

প্রবাদ প্রবচন ও বিয়ের গানের জন্য পিরোজপুর বিখ্যাত। বর্তমানে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, দিশারী শিল্পী গোষ্ঠী,সংগীতা, ধ্বনি শিল্পী গোষ্ঠী, রুপান্তর নাট্য গোষ্ঠী, পিরোজপুর থিয়েটার, কৃষ্ণচুড়া থিয়েটার, বলাকা নাট্যম্ প্রভৃতি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী আঞ্চলিক ঐতিহ্য লালন পালন ও প্রচারে একাগ্র প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।



Related

পিরোজপুর কত নম্বর সেক্টরে ছিল?

মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুর ছিল মুক্তিযুদ্ধের নবম সেক্টরের অধীন সুন্দরবন সাব-সেক্টর মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ এর কমান্ডের আওতায়।



Related

পিরোজপুর জেলার ভৌগোলিক সীমানা

পিরোজপুরের উত্তরে বরিশাল জেলা ও গোপালগঞ্জ জেলা, দক্ষিণে বরগুনা জেলা, পূর্বে ঝালকাঠি জেলা ও বরগুনা জেলা এবং পশ্চিমে বাগেরহাট জেলা ও সুন্দরবন অবস্থিত। পশ্চিমে বলেশ্বর নদী পিরোজপুরকে বাগেরহাটের থেকে আলাদা করেছে।



Related

পিরোজপুর জেলার জনসংখ্যা কত?

২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পিরোজপুর জেলার মোট জনসংখ্যা ১১,১৩,২৫৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৫,৪৮,২২৮ জন এবং মহিলা ৫,৬৫,০২৯ জন। মোট পরিবার ২,৫৬,০০২টি।



Related

পিরোজপুর জেলার ভূ-ভাগের গঠন

পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক মতে, ঋগবেদের আমলেও বঙ্গের দক্ষিণভাগ ছিল অতল সমুদ্রে নিমজ্জিত। মৌর্যযুগে পলল সংযোগে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ গড়ে ওঠলে ভূ-তাত্ত্বিকভাবে ক্রমশ পিরোজপুর ভূ-ভাগের পলল উত্থান ঘটে। পৌরাণিক নদী গঙ্গার পূর্বগামী শাখা নলিনী, হলদিনী, পাবনী নামে পরিচিত ছিল। পৌরাণিক নদীর উত্তরসূরী আধুনিক গঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, সুগন্ধার পলিরেণু গাঙ্গেয় বদ্বীপে যে সব দ্বীপ তথা নব্য ভূ-ভাগ সৃষ্টি করে, পিরোজপুর জেলার জনপদ সে সব দ্বীপেরই অংশবিশেষ। তবে জনপদ হিসেবে গড়ে ওঠেছে আরও পরে। ঐতিহাসিকদের ধারণায় পাল ও সেন আমলে বিচ্ছিন্নভাবে জনবসতি গড়ে উঠতে শুরু করলেও মূলত মোগল ও সুলতানি আমলে এ অঞ্চলে ব্যাপক জনবসতি গড়ে ওঠে। তবে উনিশ শতক পর্যন্ত পিরোজপুর জেলার একটি অংশ ছিল জলাশয়। এর মধ্যে স্বরূপকাঠির সাতলা, নাজিরপুরের বিল ও ভান্ডারিয়া অঞ্চলে চেচরি-রামপুর বিল অন্যতম।