ঝিনাইদহ একটি প্রাচীন জনপদ। অসংখ্য কিংবদন্তি, ঐতিহাসিক ঘটনাবলি ও তথ্যাবলীতে সমৃদ্ধ। এই জনপদের সুদীর্ঘ গৌরবময় ইতহাসও অতিপ্রাচীন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, নীল বিদ্রোহ, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধসহ সমসত্ম আন্দোলনে এ জেলার মানুষের রয়েছে গর্ব করার মত অবদান। শিক্ষা, সংস্কৃতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, উর্বর ভূমি এসবই স্রষ্ঠার শ্রেষ্ঠ দান হিসেবে জেলাবাসী মনে করে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব, কৃষি-মৎস্য, প্রত্নতত্ব ও ভৌগলিক অবস্থানের দিক দিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এই জেলাটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান অধিকার করে আছে এবং অনেক পূর্ব থেকে এটি সমৃদ্ধি অর্জন করেছে।
ঝিনাইদহ অঞ্চলটি দূর অতীতে তমাশাবৃত, জঙ্গলাকীর্ণ ও কেয়াবন আচ্ছাদিত ছিল। এসময় অঞ্চলটি সুন্দরবনের বর্ধিতাংশ বলে গণ্য হতো। অনেকে এ অঞ্চলকে সুর্যদ্বীপ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন।
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের পর ইরান-ইরাক-তুরষ্ক ও আফগানিস্থান থেকে অনেক সুফী দরবেশ, পীর-আউলিয়া ধর্ম প্রচারের জন্য ঝিনাইদহে আসেন। তারা এ অঞ্চলের কালীগঞ্জ, বারোবাজার, কোটচাঁদপুর, মহেশপুর সহ বিভিন্ন এলাকায় ধর্ম প্রচারের সাথে সাথে আবাস গড়ে তোলেন। জেলার বারোবাজার, শৈলুকপা, কোটচাঁদপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের নির্মিত মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপত্যের নিদর্শন আজও পাওয়া যায়।
প্রখ্যাত সাধক মরমী কবি লালন সাঁই, পাগলা কানাই, গণিত বিদ কে.পি. বসু, কবি গোলাম মোসত্মফার জন্মস্থান ঝিনাইদহ। বিপস্নবী বাঘা যতীন, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান ও বীর প্রতীক সিরাজুল ইসলামের বীরত্বগাঁথা এবং ৭১’র স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশের প্রথম সম্মুখ যুদ্ধের জেলা ঝিনাইদহ। গাজী-কালু-চম্পাবতীর উপাখ্যানখ্যাত হাওড়, বাওড়-নদী-কলা-পান, খেজুর গুড়, ধান-ফসলের প্রাচুর্যে ভরা খাদ্য ভান্ডার এই ঝিনাইদহ।
প্রাচীন যুগের বিভিন্ন শাসনামলে ঝিনাইদহে স্থায়ী জনবসতি ও সু-সংগঠিত সমাজ ব্যবস্থার ইংগিত পাওয়া যায়। খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতকে ঝিনাইদহ বঙ্গঁ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল বলে ধারণা করা হয়। ষষ্ট শতকে গুপ্ত রাজ্যের অধীন এবং ঐ শতকের মধ্যভাগে বঙ্গঁগুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন হলে বাংলা বঙ্গঁ বা সমতট এবং গৌড় এই দুটি স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ঝিনাইদহ অঞ্চলটি বঙ্গঁতথা সমতট রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। ৭ম শতকে গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক এবং শশাঙ্কের মৃত্যুর পর সম্রাট হর্ষবর্ধনের অধীনে শাসিত হয়। ৭২৫-৭৩৫ খ্রীষ্টাব্দ সময়কালে কনৌজর রাজা যশোবর্ধন গৌড় ও বঙ্গঁ রাজ্য অধিকার করে নিলে ঝিনাইদহসহ সমগ্র বাংলা তার অধীনে চলে যায়। ৭৮১-৮২১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ঝিনাইদহ পাল রাজবংশের অন্তর্গত ছিল। পল বংশের পতনের পর ১০৮০-১১৫০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যস্ত বর্মণরা ঝিনাইদহ অঞ্চল শাসন করে। ১১৫০ সালে বর্মণ রাজবংশ সেন রাজবংশের কাছে পরাজিত হলে ঝিনাইদহ সেন রাজ বংশের কর্তৃত্বে চলে যায়। ১২০৪ সালে বখতিয়ার খলজি বঙ্গঁ বিজয়ের পর ১২৬৮ থেকে ১২৮১ পর্যমত্ম ঝিনাইদহ মুসলিম রাজ্য তথা দিল্লী সালতানাতের অধীনে লক্ষনাবতীর অন্তর্ভূক্ত হয়।
১৩৪২ সালে সুলতান শাসুদ্দিন ইলয়াস শাহ্ লক্ষনাবতীকে স্বাধীন সালতানাত ঘোষণা করে বাংলাকে একটি প্রশাসনিক কাঠামোতে আনেন। তাঁর আমলে মুসলিম শাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবর্তন আনা হয়। সেসময় ঝিনাইদহ তার শাসনাধীনে ছিল। মুসলিম শাসনের হুসাইন শাহী আমলেও ঝিনাইদহের প্রশাসানিক কাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। হুসেইন শাহী বংশের বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সুলতান গিয়াস উদ্দীন মহম্মদ শাহ্ (১৫৩২-১৫৩৮ খ্রীষ্টাব্দ) দিল্লীর পাঠান সুলতান শের শাহের নিকট পরাজিত হলে বাংলা দিল্লীর শাসনাধীনে চলে যায়।
১৫৩৯-১৫৫৩ পর্যন্ত ঝিনাইদহ পাঠান সুলতানদের দ্বারা শাসিত হয়। এরপর ১৫৭৬ সালে দাউদ করোনারীর আমলে বাংলায় মোঘল শাসনের সূচনা হয়। এর প্রায় ৩৬ বছর পর ঝিনাইদহ মোঘল সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। সম্রাট আকবরের আমলে বারো ভূইয়াদের যশোরের এক রাজা ভূমি রাজস্ব আদায়সহ ঝিনাইদহে শাসন কার্য পরিচালনা করতে থাকেন। এসময় রাজা প্রতাপাদিত্য মোঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে ১৬১২ সালে মোঘল সেনাপতি তাকে পরাজিত করে। এইসময় মোঘল আমলে ঝিনাইদহে ভূমি রাজস্ব স্তর ও ফৌজদারীসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।
সম্রাট শাহজাহানের আমলে যশোরে একটি পৃথক ফৌজদারি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং ঝিনাইদহ ঐ ফৌজদারীর অন্তর্ভুক্ত হয়। মোঘল সাম্রাজ্যের অধীনে বাংলার রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা প্রাপ্ত সুবাদার মুর্শিদ কুলি খাঁর আমলে ১৭০৩ খ্রীষ্টাব্দের পর সীতারাম রায় নামক একজন ভূ-স্বামীর আবির্ভাব ঘটে এবং ঝিনাইদহের শাসনভার তার হাতে চলে যায়। সীতারামের পতনের পর ১৭১৪ খ্রীষ্টাব্দে যশোর ফৌজদারী চাচড়া, নলডাঙ্গা ও মহম্মদ শাহী এই ৩টি জমিদারির মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। ঝিনাইদহ নলডাঙ্গা ও মহম্মদ শাহী জমিদারীর আওতায় ছিল। এ দু’জমিদারীর প্রশাসনিক কাঠামোর চিহ্ন ঝিনাইদহে আজো রয়েছে।
১৭৫৭ সালের ২৩জুন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর বেতনভূক্ত সেনাপতি লর্ড ক্লাইভ এর কাছে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা পরাজয় বরণের ফলে বাংলা ও ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের সূত্রপাত ঘটে। ১৮৮১ সালে ঝিনাইদহ ইংরেজ শাসনের আওতায় আসে। ওই সময় ইংরেজ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী যশোরের মুরলীতে একটি অফিস বা কোর্ট স্থাপন করেন। বৃহত্তর যশোর, খুলনা, ফরিদপুর জেলাকে ওই কোর্টের অধীনে আনা হয়। এই কোর্টের ১ম জর্জ ও ম্যাজিষ্ট্রেট নিযুক্ত হন ইংরেজ টিলম্যান হেংকেল। ইংরেজরা ঝিনাইদহের বিভিন্ন অঞ্চলে চাষীদের ওপর চাপিয়ে দেয় নীল চাষ। ঝিনাইদহের খালিশপুর, বিজুলিয়া, বাঘাডাঙ্গা, সাধুহাটি সহ বিভিন্ন স্থানে নীল কুটি স্থাপন করা হয়। নির্যাতিত চাষীদের নীল বিদ্রোহের ফলে ১৮৬০ সালে নীল কমিশন গঠন হয় ও নীল চাষ বন্ধ হয়। নীল বিদ্রোহে ঝিনাইদহের কৃষকরা বাঁশ কেটে সুচলো করে লোহার ফালা লাগিয়ে চেঙ্গা জোরে ছুড়ে সাহেবদের ঘায়েল করতো।
ঝিনাইদহের রয়েছে বীরত্বগাথা ইতিহাস। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝিনাইদহের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েন। এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল সদর উপজেলার বিষয়খালিত। প্রায় ৩ ঘন্টা তুমুল যুদ্ধের পরও ব্যর্থ হয়ে পাকিস্থানী সেনাদল পিছু হটে যায়। সারা জেলায় মুক্তিযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধ শেষে ৩ ডিসেম্বর মহেশপুর, ৪ ডিসেম্বর কোটচাঁদপুর, ৫ ডিসেম্বর কালিগঞ্জ ও ৬ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ শহরস্থ সমগ্র জেলা স্বাধীন হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে সারা জেলায় ১৭৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীন হন।
জেলার শৈলকুপা থানা একসময় ফরিদপুর জেলার মধ্যে এবং মহেশপুর বনগাঁ মহাকুমার মধ্যে ছিল। ১৯৪৭ সালে মহেশপুর বাদে বনগাঁ মহাকুমা ভারতের অংশ হয়ে যায়। মহেশপুরকে সে সময় অবিভক্ত যশোর জেলার খাদ্য ভান্ডার বলা হতো।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় এ জেলার রয়েছে ঐতিহ্য। ঝিনাইদহকে বলা হয় দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চেলর প্রবেশদ্বার। ১৯১৩-১৪ সালে ঝিনাইদহে রেলগাড়ি চলতো। জে.জে (যশোর-ঝিনাইদহ) রেল কোম্পানী গঠন করে রেলপথ নির্মিত হয়। রেলপথটিকে মার্টিন কোম্পানীর রেল পথ বলেও দাবী করা হয়ে থাকে। তখন আপ-ডাউন আটটি ট্রেন এ জেলায় চলাচল করতো। যশোর-ঝিনাইদহ ২৮ মাইল রাস্তার মধ্যে প্রসন্ননগর, কালীগঞ্জ, বারোবাজার ও চুড়ামনকাঠীতে রেলষ্ট্রেশন ছিল। এসময় কোটচাঁদপুরে চিনি শিল্প গড়ে ওঠায় কালীগঞ্জকে জংশন করে কোটচাঁদপুর পর্যন্ত ৮ মাইল রেল লাইন সম্প্রসারিত করা হয়। তখন রেলের ভাড়া ছিল ১ পয়সা। পরে ১৯৩৫-৩৬ সালে বাস সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। যশোর-ঝিনাইদহ বাস সার্ভিস চালু হয়।
নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবার ঝিনাইদহ জেলায় পাওয়া যায়। তবে আমার মতে ঝিনাইদহের বিখ্যাত খাবার যা আমাদের নিজস্ব আইডেনটিটি দেয় সেই খাবার গুলো হলো ঝিনাইদহের নলিন গুড়ের পায়েস, জীড়ান খেজুর রসের ক্ষীর,খালিশপুরের চমচম, মাছের মাথা দিয়ে শুক্তো।
ঝিনাইদহ যশোর জেলার একটি মহকুমা ছিল। ঝিনাইদহ জেলাটি ১৮৬২ সালে মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৮৪ সালে এটি একটি পৃথক জেলা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝিনাইদহ জেলা ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে।
ঝিনাইদহ যশোর জেলার একটি মহকুমা ছিল। ঝিনাইদহ জেলাটি ১৮৬২ সালে মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৮৪ সালে এটি একটি পৃথক জেলা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝিনাইদহ জেলা ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে।
এই জেলার নামকরণ সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। কথিত আছে যে, ক্যালসিয়াম উৎপাদনের জন্য '‘নবগঙ্গা’' নদী এবং '‘দহা’' নদী থেকে ঝিনুক সংগ্রহের জন্য এই এলাকা বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। এই জেলার নাম ঝিনাইদহ “ঝিনুক”এবং “দাহ”শব্দদ্বয় থেকে নেয়া হয়েছে বলে মনে করা হয়।