প্রাচীনকালে এ অঞ্চল তথা বৃহত্তর মাদারিপুর মহকুমার নাম ছিল ইদিলপুর যা কোটালিপাড়া অথবা চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরবর্তীতে বিক্রমপুরের অধীনে নাম ছিল কেদারপুর। বারোভূঁইয়ার বিপ্লবী চাঁদ রায় ও কেদার রায় (মৃ: ১৬০৩), দক্ষিণ বিক্রমপুরের আড়া ফুলবাড়িয়ায়(বর্তমান নদীতে বিলীন নড়িয়া উপজেলার অংশ) জন্মগ্রহণ করেন। কেদার রায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রায়পুর নামের গ্রামটি। তাদের রায়বংশ অনুসারেই নাম হয়েছিল রায়পুর যা কয়েক শতাব্দী ধরে ছিল। সেই গ্রামের নাম এখন পুটিজুরি। আজ আর চাঁদ রায়, কেদার রায়দের কোন চিহ্নমাত্র নেই সেখানে। শুধু পাশের গ্রামে তাদের খনন করা দুটি বিশাল দীঘি রয়ে গেছে। এখনো দিগম্বরী দেবীর পূজা হয় সেখানে। তাই এই দিঘীগুলোর বর্তমান নাম দিগম্বরীর দীঘি। শুধু এই দীঘি দুটিই পদ্মার এপারে বারোভূঁইয়া কেদার রায়কে মনে রেখেছে। পদ্মায় ভেসে গেছে রায়পুরের ইতিহাস। কেদার রায়ের খনন করা দিগম্বরীর দিঘির একটু দূরেই এখনও কিছু পোড়া ইট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা বাড়ি। সেখানে এখন অন্য লোকের বসতি। স্থানীয় লোকেরা বাড়িটাকে বলে ‘ভিয়া বাড়ি’। ধারণা করা হয় ‘ভুঁইয়া বাড়ি’ মানুষের মুখে মুখে অপভ্রংশ হতে হতে ‘ভিয়া বাড়ি’ হয়ে গেছে।
কেদার রায় কেদারপুরে বাসস্থান তৈরী করতে চেয়েছিলেন। কিছু কাজ সমাপানান্তে তার মৃত্যু হওয়াতে তা পরিত্যক্ত হয়। বাড়ির চতুষ্পার্শ্বে যে পরিখা খনন করতেছিলেন তার ভগ্নাবশেষ এখনও রয়েছে। ইহাকে কেদার রায়ের বাড়ির বেড় (পরিখা) বলে।
ফতেজঙ্গপুরে মান সিংহ র নেতৃত্বাধীন মোঘল বাহিনী ও রাজা কেদার রায়ের প্রতিরোধকারী বাহিনীর মধ্যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয়। প্রাচীন নাম শ্রীনগর। মুঘল সেনাপতি মানসিংহ যখন বিক্রমপুর আক্রমণ করেন তখন তার সহযোগী যোদ্ধাগণ এখানকার রাজা কেদার রায় কর্তৃক পরাস্ত হয়ে শ্রীনগরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মানসিংহ তাদেরকে উদ্ধারের জন্য তার সেনাবাহিণী প্রেরণ করেন। ফলে প্রচন্ড যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। তিনি মোগলদের জয়ের চিহ্ন স্বরুপ মানসিংহ সেখানে ফতেজঙ্গপুর দুর্গ নির্মান করেন এবং শ্রীনগরের নাম পরিবর্তন করে ফতেজঙ্গপুর রাখেন। এখানে নাককাটা বাসুদেবের প্রস্থর মূর্তি আছে। তথাপি কেদার রায়ের মৃত্যুর পর সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে বাংলার গভর্ণর ইসলাম খার (১৬০৮-১৬১৩) সময়েই মূলতঃ এ দেশে মুগল রাজত্বের ভিত্তি হয়। তখন হতেই মাদারিপুর অঞ্চলসহ বাংলার এ এলাকা মুগলদের পতন পর্যন্তই তাদের দখলে ছিল। ইসলাম খানের পর একুশজন গভর্নর ১৬১৩ হতে ১৭৫৭ পর্যন্ত এ অঞ্চল শাসন করেন। ১৭৫৭ সালের সেই পলাশির মর্মান্তিক পরিণতির পূর্ব পর্যন্ত নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলার স্বাধীন নওয়াব হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন।
শরীয়তপুর জেলা পূর্বে বৃহত্তর বিক্রমপুর এর অংশ ছিল। ১৮৬৯ সালে প্রশাসনের সুবিধার্থে ইহাকে বাকেরগঞ্জ জেলার অংশ করা হয়। কিন্তু এ অঞ্চলের জনগণের আন্দোলনের মুখে ১৮৭৩ সালেই এ অঞ্চলকে মাদারীপুর মহকুমার অন্তর্গত করে ফরিদপুর জেলার অংশ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
ভাইসরয় লর্ড কার্জনের সময় ১৯০৫ সালে বাংলাকে দু‘টো ভাগে বিভক্ত করা হয়। এ বিভক্ত বাংলার ইতিহাসে সুদুর প্রসারী ফল বিস্তার লাভ করে।
এর পর ক্রমে ক্রমে শরীয়তপুরের অঞ্চল সহ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে স্বাধীনতা সংগ্রামের সুত্রপাত হয়। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয় রাজনৈতিক দলের কর্মীরাই এ জেলায় সক্রিয় ছিলেন। এমনকি ১৯১০ হতে ১৯৩৫ সালের দিকে এ অঞ্চলের বহু বিপ্লবী সক্রিয়ভাবে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে ভারতের স্বাধীনতার জন্য অংশ নেন। লোনসিংএ জন্মগ্রহণকারী বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাস এদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
১৯৪৭ সালর ১৪ ই আগস্ট হতে ১৯৭১ সালের ১৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত শরীয়তপুর জেলা সহ এ প্রদেশ ছিল পাকিস্তানেরই একটি অংশ।
শাসনিক সুবিধার্থে মাদারীপুরের বৃহৎ পূর্বাঞ্চল নিয়ে একটি পৃথক মহকুমা গঠনের প্রয়াস ১৯১২ সাল হতেই নেয়া হয়েছিল। এর পরে পাকিস্তান সৃষ্টিও বাংলাদেশের অভ্যুদয় নতুন প্রশাসনিক দৃষ্টি ভঙ্গি গঠন করতে সহায়তা করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ সালে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় মাদারীপুরের পূর্বঞ্চল নিয়ে একটি নতুন মহকুমা গঠিত হবে। বিষয় নির্বাচনী কমিটির সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক, ব্রিটিশ বিরোধী তথা ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়ত উল্লাহর নামানুসারে এর নাম করণ হয় শরীয়তপুর এবং এর সদর দপ্তরের জন্য পালং থানা অঞ্চলকে বেছে নেয়া হয়।
১৯৭৭ সালের ১০ ই আগস্ট রেডিওতে সরকার কর্তৃক মহকুমা গঠনের ঘোষণা দেয়া হয় এবং ঐ বছরের ৩রা নভেম্বর এ মহকুমার আনুষ্ঠানিক শুভ উদ্বোধন করেন তৎকালীন উপদেষ্টা জনাব আবদুল মোমেন খান। প্রথম মহকুমা প্রশাসক ছিলেন জনাব আমিনুর রহমান। এর পর রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোঃ এরশাদ সরকারের প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের ফলে শরীয়তপুর মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর করা হয়। ৭ই মার্চ ১৯৮৩ সালে জেলা গঠনের ঘোষণা হয়। ১৯৮৪ সালের ১লা মার্চ শরীয়তপুর জেলার শুভ উদ্বোধন করেন তৎকালীন তথ্য মন্ত্রী জনাব নাজিম উদ্দিন হাশিম। বর্তমান শরীয়তপুর বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী জেলা।
৭ই মার্চ ১৯৮৩ সালে জেলা গঠনের ঘোষণা হয়। ১৯৮৪ সালের ১লা মার্চ শরীয়তপুর জেলার শুভ উদ্বোধন করেন তৎকালীন তথ্য মন্ত্রী জনাব নাজিম উদ্দিন হাশিম।
১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল মাদারীপুর মহকুমার (বর্তমান শরিয়তপুর ও মাদারীপুর) পতন হলে তিনি মুক্তিসেনাদের নিয়ে ২ সেক্টরে যোগ দেন। এখানে তিনি সাব-সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শরীয়তপুর জেলা বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের ঢাকা বিভাগের (প্রস্তাবিত ফরিদপুর বিভাগের) একটি প্রশাসনিক অঞ্চল।
শরীয়তপুর অনেক আগে থেকেই মৃৎশিল্প ও পিতলের জিনিসপত্রের জন্য বিখ্যাত। এখানকার টেরাকোটা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের পটারি ইউরোপসহ বিশ্বের ২০টি দেশে যায়। শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মনে করেন, পদ্মা সেতু এই দুই শিল্পকে আরও এগিয়ে নেবে।
ময়দার কল : ৪ টি। বরফের কল : ১৩ টি। তেলের কল : ৩ টি। পূর্বে এই জেলা কাশা ও পিতলের তৈজষপত্র তৈরীর জন্য বিখ্যাত ছিল।