ভূমিকা : জনসংখ্যা বিস্ফোরণে ভারাক্রান্ত তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ বাংলাদেশ। উন্নয়ন অগ্রগতি ও অর্থনীতির গতিশীল চাকাকে জনসংখ্যা সমস্যা মন্থর করে দিয়েছে। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আজ তাই জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করা সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। জনসংখ্যা যখন কোনো দেশের সমস্যার বদলে শক্তিতে পরিণত হয়, তখন আমূল পরিবর্তন ঘটে সেই দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতির।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্য : আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর ক্ষুদ্রতর দেশগুলোর অন্যতম। এ দেশের জনবসতি অত্যন্ত ঘন। সরকারের এক হিসাব অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে বর্তমানে বাংলাদেশের মোট লোকসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। বাংলাদেশে ১৫ বছরের কম এবং ৬০ বছরের বেশি বয়সের লোকের সংখ্যা অধিক হওয়ায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠী দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করতে পারছে না। পুরুষের সংখ্যা আর নারীর সংখ্যা প্রায় সমান হলেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পুরুষের মতো নারী সমান অবদান রাখতে পারছে না। দেশের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ লোক শিক্ষিত। ব্যাপক নিরক্ষরতা জনসংখ্যা সমস্যাকে করে তুলেছে প্রকট।
জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি : দ্রুত বেড়ে চলেছে পৃথিবীর জনসংখ্যা। পৃথিবীর মানুষকে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করে তোলার জন্যে প্রতিবছর ১১ জুলাই তারিখে পালিত হয় বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। বর্তমানে বিশ্বের জনসংখ্যা প্রায় ৭০০ কোটি। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী এর মধ্যে শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোর জনসংখ্যার পরিমাণ প্রায় ৪৫০ কোটি। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে, আগামী এক দশকের মধ্যেই বিশ্বের জনসংখ্যা আরো প্রায় একশ কোটি বেড়ে যাবে এবং এই বৃদ্ধির শতকরা ৯০ ভাগ ঘটবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। তাই জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে না পারলে পিছিয়ে-পড়া দেশগুলোর দুর্বল অর্থনীতি ক্রমেই নাজুক ও বিপন্ন হয়ে পড়বে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ : পৃথিবীতে জনসংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে অথচ সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে গাণিতিক হারে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় সম্পদ কমহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় দেখা দিচ্ছে খাদ্য ঘাটতি। বাংলাদেশে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির অনেকগুলো কারণ রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে দারিদ্র্য এবং নিম্নমানের জীবনযাত্রা, অশিক্ষা, ভৌগোলিক প্রভাব, ধর্মীয় এবং সামাজিক কুসংস্কার, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ, জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে অজ্ঞতা ইত্যাদি প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচ্য। এছাড়াও বিনোদনের অব্যবস্থা, খাদ্যাভ্যাস, মৃত্যুহার হ্রাস ইত্যাদিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কুফল : বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এই জনগোষ্ঠীর মধ্যেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। দেশে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সুচিকিৎসা, শিক্ষা, বিশুদ্ধ পানি ইত্যাদির অভাব বেড়েই চলেছে। ফলে জীবনযাত্রার মানেরও ঘটছে অবনতি সৃষ্টি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা। প্রধান কিছু সমস্যা হচ্ছে-
ক. বাংলাদেশের তীব্র খাদ্যসংকটের মূল কারণ অত্যধিক জনসংখ্যা। খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য বাংলাদেশকে প্রতিবছর ১০-১২ লক্ষ টন খাদ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন দারুণভাবে বাধাগস্ত হচ্ছে।
খ. বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়নের গতি অত্যন্ত মন্থর। কৃষির ওপরেও রয়েছে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ। অন্যদিকে দেশে সঠিক কর্মব্যবস্থাপনা না থাকায় জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশ বেকার থাকছে। এ সমস্যা ক্রমেই জটিলতর রূপ ধারণ করছে। বর্তমানে দেশের কর্মক্ষম লোকদের শতকরা প্রায় ৩০ ভাগই বেকার জীবনযাপন করছে।
গ. জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাসস্থান নির্মাণ সম্ভব হচ্ছে না। ফলে শহরাঞ্চলে বাসস্থান সমস্যা প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে বাড়তি জনসংখ্যার জন্য বাসস্থান তৈরি করতে গিয়ে কমে আসছে চাষের জমির পরিমাণ।
ঘ. জনসংখ্যা যতই বৃদ্ধি পাবে ততই স্কুল-কলেজের সংখ্যা বাড়াতে হবে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান লোকের শিক্ষার জন্যে দরিদ্র এ দেশ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে দারিদ্র্য এবং অপুষ্টির। কারণে জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ শিক্ষা হতে বঞ্চিত হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কমে যাচ্ছে শিক্ষিতের হার।
ঙ. দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছে। জনসংখ্যার অত্যধিক বৃদ্ধির ফলে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের অপ্রতুলতা, ময়লা ও পানি নিষ্কাশনের অব্যবস্থা, ব্যাপকহারে বৃক্ষ নিধন, অনিয়ন্ত্রিতভাবে কলকারখানা স্থাপন ইত্যাদি ঘটছে। এর ফলে দেশের পরিবেশ এবং স্বাস্থ্য মারাত্মক দূষণের শিকার হচ্ছে।
জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের উপায় : কোনো সমস্যাই চিরকাল স্থায়ী হয় না। সব সমস্যারই কোনো-না-কোনো সমাধান এবং প্রতিকার রয়েছে। উন্নয়নকামী দেশ জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান খোঁজে অগ্রগতির পথ পাওয়ার জন্য। এই সমস্যা সমাধানের জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি উপায়। যেমন-
ক. দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতির হারকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তুলনায় বেশি করতে পারলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
খ. শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে সমাজ থেকে কুসংস্কার ও গোঁড়ামি দূর করে জনসাধারণকে পরিবার পরিকল্পনায় উদ্বুদ্ধ করে তুলতে হবে।
গ. পরিমাণগত নিয়ন্ত্রণের চেয়ে গুণগত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই জনসংখ্যা সমস্যার প্রকৃত সমাধান সম্ভব। এ লক্ষ্যে দেশে শিক্ষার বিস্তার, কারিগরি দক্ষতার বিস্তার এবং কর্মশক্তি বৃদ্ধির ব্যবস্থার দ্বারা জনসংখ্যার গুণগত মান বৃদ্ধির মাধ্যমে একে সমস্যার বদলে সম্পদে রূপান্তর করা সম্ভব।
ঘ. বাংলাদেশে আয়ের ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য বিদ্যমান। আয়ের সুষম বণ্টন, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান সম্ভব।
ঙ. সর্বোপরি আইন প্রণয়নের মাধমে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ রোধ ও গর্ভপাত অনুমোদন করা সম্ভব হলে জনসংখ্যা হ্রাস পাবে। এছাড়া বিয়ের ন্যূনতম বয়স বৃদ্ধি করতে হবে। ব্যাপক প্রচার এবং গণসচেতনতা বৃদ্ধির মাধমে এই আইনসমূহের সফল প্রয়োগ ঘটাতে হবে।
উপসংহার : পরিকল্পিত পরিবার গঠন ও জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে একটি সর্বজনীন জাতীয় নীতিমালা প্রণীত হওয়া আবশ্যক। সাথে সাথে শিক্ষা বিস্তার করতে হবে এবং জাতীয় আয়ের সুষম বণ্টন করে জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে হবে। আর তাহলেই জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে।
[চ. বো. ১৪, দি. বো. ১১]