ভূমিকা : বাংলাদেশ উৎসবের দেশ। বাঙালি জাতি উৎসবমুখর জাতি হিসেবে বিশ্বে পরিচিত। এই বাংলার বুকে নানা ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষের বসবাস রয়েছে। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই মিলেমিশে বাস করে এই বাংলায়। নানা ধর্মের মানুষের নানা উৎসবে বাংলাদেশ বর্ণিল হয়ে ওঠে। একের উৎসবে অন্যরাও স্বতঃস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে। বাঙালির এ উৎসব উদযাপন যেন রবীন্দ্রনাথের সেই উক্তিকেই স্মরণ করিয়ে দেয় ‘আমার আনন্দ সকলের আনন্দ হউক, আমার শুভ সকলের শুভ হউক, আমি যাহা পাই, তাহা পাঁচজনের সহিত মিলিত হইয়া উপভোগ করি এই কল্যাণী ইচ্ছাই উৎসবের প্রাণ।’
বাংলাদেশের বিভিন্ন উৎসব : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ধরনের উৎসবের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এসব উৎসবের কোনোটা ধর্মীয়, কোনোটা সামাজিক এবং কোনোটা পারিবারিক। বাংলাদেশে প্রচলিত নানা ধরনের এসব উৎসব সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো :
(ক) ধর্মীয় উৎসব : বাংলাদেশে নানা ধর্মের মানুষ বসবাস করে। প্রত্যেকের উৎসবও আলাদা আলাদা। ধর্মীয় উৎসবগুলোর মধ্যে মুসলমানদের দুটি ঈদ, হিন্দুদের দুর্গাপূজা, কালীপূজা, সরস্বতী পূজা, জন্মাষ্টমী, খ্রিস্টানদের ইস্টার সানডে, বড়দিন, বৌদ্ধদের বুদ্ধ পূর্ণিমা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
(১) ঈদ : মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব হলো ঈদুল ফিতর। রমজান মাসে পুরো এক মাস রোযা রাখার পর আসে ঈদুল ফিতরের আনন্দঘন মুহূর্ত। এ দিন সবাই নতুন পোশাক পরিধান করে, ঈদের জামাতে যোগ দেয়, মিষ্টিমুখ করে এবং আরও নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ঈদের আনন্দকে সবার মাঝে ভাগ করে নেয়। মুসলমানদের আরেকটি বৃহৎ উৎসব হলো ঈদুল আজহা। একে কোরবানির ঈদও বলা হয়। এটি হচ্ছে আত্মত্যাগের ঈদ। এ ঈদেও অত্যন্ত আনন্দের সাথেও জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালন করা হয়।
(২) পূজা : হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব হলো দুর্গাপূজা। শরৎকালে এ পূজা হয় বলে একে শারদীয় দুর্গোৎসবও বলা হয়। আশ্বিন মাসে যে চাঁদ ওঠে তার সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী এই তিন দিন পূজা অনুষ্ঠিত হয়। দশমীর দিন মাকে বিসর্জন দেওয়া হয় পুকুরে বা নদীতে। এ পূজা অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়। এছাড়া হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মাঝে সরস্বতী পূজা, কালী পূজা, ল²ীপূজা পৃভৃতিতে উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
(৩) বড়দিন : বড়দিন হলো যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন। এ দিনকে ঘিরে খ্রিস্টান সম্প্রদায় বেশ আনন্দ করে থাকে। গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করার পর সকলের সাথে কুশল বিনিময়ের মাধ্যমে বড়দিনের উৎসব উদ্যাপনের সূচনা হয়।
(৪) বৌদ্ধ পূর্ণিমা : বৌদ্ধ পূর্ণিমা হলো গৌতম বুদ্ধের জন্মদিন। এদিন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা উৎসব পালন করে থাকে। বৌদ্ধবিহারে এদিন অনুষ্ঠিত হয় প্রভাবফেরি, ফুলপূজা, প্রদীপপূজা প্রভৃতি। এছাড়া বিহারগুলোতে এদিন পঞ্চশীল ও অষ্টশীল প্রদান করা হয়।
(খ) সামাজিক উৎসব : সামাজিক উৎসব পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো আনন্দ উপভোগ করা। বাংলাদেশের সামাজিক উৎসবের মধ্যে বিভিন্ন জাতীয় উৎসবও রয়েছে।
(১) স্বাধীনতা দিবস : ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরুর পথ উন্মুক্ত হয়। আমরা প্রতিবছর আনন্দের সাথে দিনটি পালন করে থাকি।
(২) বিজয় দিবস : আমরা বিজয় দিবস উদ্যাপন করে থাকি প্রতিবছরের ১৬ই ডিসেম্বরে। এ দিনই আমরা স্বাধীন দেশ ও জাতি হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছিলাম। তাই বিজয় দিবস আমাদের কাছে বিশেষ তাৎপর্যবহ।
(৩) নবর্বষ : নববর্ষ বাঙালির অন্যতম সামাজিক উৎসব। প্রতিবছর পয়লা বৈশাখের দিন আমরা নববর্ষ উদ্যাপন করি। নববর্ষকে ঘিরে সারা দিনব্যাপী আয়োজনের মধ্যে রয়েছে- মঙ্গল শোভাযাত্রা, বৈশাখী মেলা, হালখাতা ইত্যাদি। সর্বস্তরের জনগণ এ উৎসব অত্যন্ত আনন্দের সাথে উদ্যাপন করে থাকে। এটি এখন সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে।
এছাড়াও আরও যেসব সামাজিক উৎসব রয়েছে সেগুলো হলো
(১) পহেলা ফাল্গুন : বাঙালি উৎসবমুখর জাতি। উৎসবের তালিকায় পহেলা ফাল্গুন এমনি একটি উৎসব। বসন্তকে বরণ করে নিতে এ উৎসব পালন করা হয়। বাসন্তী রঙের নিজেকে রাঙিয়ে তোলে সবাই পহেলা ফাল্গুনের দিনে।
(২) পৌষ-পার্বণ : এটি মূলত পিঠা উৎসব। এ উৎসবের মূল আকর্ষণ হলো নানা ধরনের পিঠা বানিয়ে খাওয়া। এছাড়া পুরান ঢাকার অধিবাসীরা এদিনে ঐতিহ্যবাহী ঘুড়ি উৎসবও উদ্যাপন করে থাকে।
(৩) বিভিন্ন ধরনের মেলা : আমাদের দেশে নানা উৎসবকে ঘিরে বিভিন্ন মেলা সকল মানুষের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ঃ বৈশাখি মেলা, একুশের বইমেলা, বাণিজ্য মেলা ইত্যাদি।
(৪) ক্রিকেট খেলা : বর্তমান সময়ে ক্রিকেট খেলাও একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে। সকলে মিলে হইচই করে স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখার আনন্দ উপভোগ করে। ওয়ানডে ম্যাচ, টি-টোয়েন্টি এরূপ বিভিন্ন খেলা মানুষকে আনন্দ দিতেই আয়োজিত হয়ে থাকে। তাই এগুলোও এখন সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে।
(৫) বিখ্যাত ব্যক্তিদের স্মরণোৎসব : বাংলাদেশে বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিদের স্মরণে নানা উৎসব পালন করা হয়। এসব উৎসবের মধ্যে রয়েছে : নজরুল জয়ন্তী, রবীন্দ্র জয়ন্তী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মোৎসব এবং অন্য মহান নেতাদের স্মরণেও অনুষ্ঠান করা হয়।
(৬) পারিবারিক উৎসব : পারিবারিক উৎসবে সাধারণত পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং ঘনিষ্ঠজনরাই উপস্থিত থাকে। পারিবারিক উৎসবের মধ্যে রয়েছেÑ বিয়ে, জন্মদিন, অন্নপ্রাশন, খাৎনা, শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ইত্যাদি।
উৎসবের তাৎপর্য : আমাদের দেশে যেসব উৎসব উদ্যাপিত হয় তার সবগুলোই সাম্য, মৈত্রী ও ঐক্যের কথা বলে। বিভিন্ন উৎসবে নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণ বাঙালির সাম্প্রয়িক সম্প্রিতিকেই উপস্থাপন করে। মানুষে মানুষে আত্মিক বন্ধন স্থাপনে ভ‚মিকা রাখে এই উৎসব। উৎসবের মাঝেই ছড়িয়ে থাকে বাঙালির প্রাণের আকুতি। একটি উৎসবকে কেন্দ্র করেই গোটা জাতি একটি পরিবারে রূপ নেয়। আনন্দমুখর পরিবেশে উৎসব উদ্যাপনে মানুষের মনের মলিনতা দূর হয়ে যায়।
উপসংহার : আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি দূর করতে উৎসব জাদুমন্ত্রের মতো কাজ করে। মানুষের মাঝে নির্মল আনন্দের সঞ্চার করে উৎসব। তাই সকল ব্যবধান ভুলে গিয়ে উৎসবের মূল উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে হবে এবং বিশুদ্ধ আনন্দকে হৃদয় দিয়ে উপভোগ করতে হবে। উৎসবের শালীনতা ও পবিত্রতা বজায় রেখে প্রকৃত অর্থে উৎসব পালনের জন্য সকলের সচেতন থাকা আবশ্যক। তবেই উৎসবের প্রকৃত আনন্দ উপভোগ করা সম্ভব হবে।