ভূমিকা : ‘খেলার রাজা’ কিংবা ‘রাজার খেলা’ বলা হয় ক্রিকেটকে। এ খেলার গৌরবময় অনিশ্চয়তা একে তুলে ধরেছে উত্তেজনা, উদ্দীপনা ও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। ক্রিকেটবিশ্বে বাংলাদেশ আজ অন্যতম শক্তিধর দল হিসেবে আবিভর্‚ত হয়েছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অভাবিত সাফল্য ক্রিকেটকে এ দেশের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত করেছে। ক্রিকেট এখন জাতির আশা- আকাঙ্ক্ষা ও প্রেরণার বাতিঘর হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে ক্রিকেটের ইতিহাস : শতাধিক বছরের বেশি সময় ধরে এ অঞ্চলে ক্রিকেট খেলার প্রচলন। ইংরেজ শাসনামলে এ দেশে তথা ভারতীয় উপমহাদেশে ক্রিকেট খেলার সূচনা ঘটে। দেশ বিভাগের কিছুকালের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রিকেট খেলার সুযোগ পায়। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানেও স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যায়ে এবং শহরগুলোতে ক্রিকেট বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু পাকিস্তান আমলে তৎকালীন শাসক ও সংগঠকদের আন্তরিকতার অভাব এবং বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এখানে আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট বিকশিত হয়নি।
আইসিসিতে বাংলাদেশ : স্বাধীনতার এক দশকের মধ্যেই বাংলাদেশ আইসিসির সহযোগী সদস্যের মর্যাদা পায়। যোগ্যতা অর্জন করে বিশ্বকাপের যোগ্যতা নির্ধারণী আইসিসি ট্রফি খেলার। প্রথম কয়েকটি আসরে বাংলাদেশের সাফল্য উল্লেখযোগ্য ছিল না। অবশেষে দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় ‘৯৭-এর আইসিসি ট্রফিতে। সেমিফাইনালে বাংলাদেশ সহজেই স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে। সেরা দুটি দেশের একটি হতে পারায় বাংলাদেশের বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত হয়। সেই সাথে বাংলাদেশ অর্জন করে ওয়ানডে খেলার মর্যাদা। তাই সেদিন আনন্দের জোয়ারে ভেসে গিয়েছিল সমগ্র বাংলাদেশ। কেনিয়াকে হারিয়ে সেবারের আসরের অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা লাভ : বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের পরপরই আইসিসির অধিবেশনে বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা লাভের আবেদন করে। পাকিস্তান ছিল সমর্থক। ওয়েস্ট-ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়ে এতে সমর্থন জানালেও ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ড দল বিরোধিতা করায় বাংলাদেশ সম্ভাব্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। অবশেষে ২০০০ সালের ২৬ জুন আইসিসির পরবর্তী সভায় সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশকে টেস্ট ক্রিকেটে মর্যাদা দেওয়া হয়। সংবাদটি বাংলাদেশে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই সারা দেশে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। জাতীয় পর্যায়েও আনন্দ উৎসব পালিত হয়।
বিশ্বকাপ ও বাংলাদেশ : ১৯৯৯-এর বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কেড়েছিল। ২৪ মে অনুষ্ঠিত খেলায় বাংলাদেশ বিশ্বকাপে প্রথম জয় ছিনিয়ে আনে স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে। প্রথম রাউন্ডের শেষ খেলায় ৩০ মে ‘৯৯ বাংলাদেশ সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন শক্তিশালী পাকিস্তানকে ৬২ রানের বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দেয়। নিজেদের সপ্তম অবস্থানসহ সুপার এইটে খেলার যোগ্যতা অর্জন ছিল সেবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য দিক। সেই সঙ্গে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করে ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে। ২০১১ বিশ্বকাপে আয়োজক দেশ ছিল বাংলাদেশ। সেরা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের তালিকায় ছিল ঢাকা। গ্রুপ পর্বে ছিটকে পড়লেও শক্তিশালী ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডকে হারিয়ে দর্শকদের মন জয় করে নেয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় অধ্যায় নিঃসন্দেহে ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত এ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স সবার নজর কাড়ে। শক্তিশালী ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বাংলাদেশ জায়গা করে নেয় কোয়ার্টার ফাইনালে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে সম্ভাবনা : বর্তমানে ক্রিকেট বিশ্বে একটি প্রতিনিধিত্বকারী দল হিসেবে বাংলাদেশের নাম উল্লেখযোগ্য। বাংলার দামাল ছেলেদের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স সেই কথাই বলছে। ঘরের মাটিতে সর্বশেষ খেলা ১৪টি ওয়ানডে ম্যাচের মধ্যে বাংলাদেশের জয় ১২টিতেই। পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ক্রিকেটীয় পরাশক্তিরা বাংলার ছেলেদের সামনে হয়েছে পর্যুদস্ত। টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ততটা ভালো ফলাফল করতে না পারলেও উন্নতির চিত্র ধরা পড়ে সহজেই। বাংলাদেশের বয়সভিত্তিক দলগুলো দেশে ও দেশের বাইরে ভালো করছে। বাংলাদেশের বেশ কয়েজন খেলোয়াড় বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেদের শক্ত অবস্থান গড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের সাকিব আল হাসান দীর্ঘদিন ধরে ক্রিকেটের তিনটি ফরম্যাটেই সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে আইসিসি র্যাংাকিংয়ে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন। বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দলও নানা পর্যায়ে দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনছে। ক্রিকেট এখন শুধু নিছক খেলাই নয়। একে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিশাল বাণিজ্যিক সম্ভাবনা। ক্রিকেট খেলাকে নেশা করে নেওয়া তরুণরা এখন পেশা হিসেবে একে গ্রহণ করতে অনেক বেশি আগ্রহী।
উন্নতির ধারা ধরে রাখতে করণীয় : ক্রিকেটকে ঘিরে বাংলাদেশের সর্বস্তরের ক্রীড়ামোদী জনতার আশা-ভরসার শেষ নেই। সেই ভরসার প্রতিদান দিতে আগ্রহের কমতি নেই খেলাটির সাথে সংশ্লিষ্ট সকলেরই। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনো আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। আমাদের দেশের ক্রিকেট মাঠের সংখ্যা এখনো অপ্রতুল। পিচগুলোর অধিকাংশই বিশ্বমানের নয়। তাই আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন ক্রিকেট মাঠ তৈরি করা খুব জরুরি। আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের কাঠামো খুবই নাজুক। এটিকে শক্তিশালী করা অত্যন্ত প্রয়োজন। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের কাঠামোকে দৃঢ় করার প্রতিও অনেক মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। বর্তমান ক্রিকেট খেলার উন্নতির জন্য নানা রকম উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত থাকলে আমাদের ক্রিকেট নিঃসন্দেহে আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
উপসংহার : নানা সমস্যায় জর্জরিত বাঙালির আশা- আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দু এখন ক্রিকেট। অন্য সব বিষয়ে নানা রকম বিভক্তি থাকলেও ক্রিকেট সাবাইকে এক করেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের উন্নতির ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে, এটিই সবার কামনা। হয়তো সেদিন আর খুব বেশি দূরে নয় যেদিন বাংলাদেশ ছিনিয়ে আনবে বিশ্বকাপের গৌরব।
[ব. বো. ১৪, রা. বো. ১৩, দি. বো. ১০]