জীবন খাতার পাতায় জমে অভিজ্ঞতার নানা বিচিত্র ঘটনা। আজ আমার জীবনে ঘটে যাওয়া এমন একটি স্মরণীয় ঘটনার তুলে ধরছি। শ্রাবণ মাস। সকাল থেকেই আকাশে মেঘের আনাগোনা। মাঝে কয়েকবার হালকা বৃষ্টি হয়েছে। বিকেলে কালো মেঘের ফাঁকে পশ্চিম আকাশে পড়ন্ত সূর্যের আবির রং দেখে মনটা নেচে ওঠে। আমরা কয়েক বন্ধু মনের আনন্দে রবিঠাকুরের কবিতায় গানের সুর তুলে গাইতে গাইতে বাড়ি হতে বের হই -
আমাদের বাড়ি থেকে হারাবিলের দূরত্ব এক কিলোমিটারের বেশি নয়। বন্যার পানিতে সেই দূরত্বরেখা মিশে গেছে। এক কিলোমিটারের ফসলের মাঠ পানিতে একাকার। বিল আর ফসলের মাঠের পার্থক্য বোঝা যায় না। বাড়ির ঘাটে বাঁধা ছিল আমাদের নৌকা।
আমাদের বৈঠার হেইয়া টানে নৌকা এগিয়ে চলছে। সূর্য ডুবে গেছে কখন আমাদের কোনো খেয়াল নেই। সন্ধ্যার আলো-আঁধারির খেলা চলছে। মেঘের ভেলা জমে জমে কখন যে আকাশ ভরে গেছে, বন্ধুদের হৈহুল্লোড় আর আনন্দ-উল্লাসে আমরা খেয়ালই করেনি যেকোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে।
হঠাৎ আকাশ ভেঙে সত্যি সত্যি বৃষ্টি নামল। আমরা বিলের পাড়ের গাঁয়ের ছেলে। ঝড়, বৃষ্টি, বাদল, বন্যা দেখে খুব সহজে সাহস হারা হই না। হারাবিল নিয়ে অনেক গল্প-কাহিনি, কিংবদন্তি এই অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত আছে। যার বেশির ভাগই ভয় আর শরীরের রক্ত হিম করার মতো। ভ‚ত পেতœী নয় তো ডাকাতের কায়-কারবার নিয়ে কল্পনার রংমাখা ভয়ংকর সব কাহিনি। আরো আছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কাহিনি। পাকবাহিনী এই বিলের বটগাছের নিচে ক্যাম্প করে কত মানুষকে মেরে বটগাছের নিচে গর্ত করে পুঁতে রেখেছে তার হিসেব নেই। সেই সব অতৃপ্ত আত্মারা নাকি সন্ধ্যা হলেই বের হয়ে ঘুরে বেড়ায় বিলের পানির ওপর দিয়ে। এমন সব কাহিনি দিনের আলোতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সন্ধ্যার অন্ধকারে কেন যেন সত্যি বলে মনে হচ্ছে।
আস্তে আস্তে বৃষ্টি বাড়তে থাকে। নৌকায় পানি জমছে। আমরা কাকের মতো ভিজছি। চারদিক অন্ধকার। দূরে গ্রামের ঘরে ঘরে জ্বলা সন্ধ্যা বাতির আলোও চোখে পড়ছে না বৃষ্টির আঁধারের ঘনঘটায়। বৃষ্টিতে ভিজে শীত শীত লাগা শুরু হলো। বাড়ির কথা মনে পড়তেই অস্বস্তি ঘিরে ধরল। বৃষ্টিমুখর এই সন্ধ্যায় আমাদের না পেয়ে নিশ্চয়ই মা-বাবা চিন্তায় অস্থির। নিজেদের অপরাধী অপরাধী মনে হচ্ছে। সবাই মিলে বৈঠা ঠেলতে লাগলাম। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আমরা বিলের মাঝখানে চলে এসেছি। হঠাৎ বৃষ্টির ছন্দময় শব্দকে মনে হচ্ছে ভ‚তের কান্না। বাতাসের শিরশির শব্দ কানে এসে বাজছে পেতœীর হিহিহি হাসির মতো। বিকট শব্দে দূরে একটা বাজ পড়ল, কিন্তু মনে হলো আমাদের ওপরই যেন পড়ল। ব্রজপাতের আলোয় যতটুকু দেখা গেল, তাতে মনে হলো আমরা ভুল পথে চলছি। আশপাশে আর কোনো নৌকা বা লোকজনের দেখা নেই। বিলের মাঝখানের ঢিবির ওপরের বটগাছ অর্ধেকটা ডুবে আছে। এই বটগাছতলায় নাকি প্রতি অমাবস্যার রাতে ভ‚তদের আসর বসে। এ কথা মনে হতেই শরীরের প্রতিটি লোম দাঁড়িয়ে গেল।
এমন সময়, ‘ঐ তো দূরে আলো দেখা যাচ্ছে’- আমাদের মাঝ থেকে একজন চিৎকার করে উঠল। আমি চমকে উঠলাম। তাকে চুপ করতে বলে বললাম। ‘ঐ দিকে তো বটগাছ। নিশ্চয়ই ভ‚তের আগুন। নয় তো ডাকাতরা ওত পেতে বসে আছে। মহাজনদের নৌকা লুট করার জন্য। চিৎকার করো না। মনে মনে আল্লাহকে ডাকো।’ আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সবাই কালিমা শাহাদাত আর দোয়া ইউনুছ পড়া শুরু করল। মনে মনে পড়তে বললেও তা আর মনে মনে থাকল না। ভয়ে কাঁপা গলায় তা এক অন্য রকম ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করল। দূরের আলো আস্তে আস্তে কাছে আসছে। আমরা অজানা ভয় আর সিদ্ধান্তহীনতার দোলাচলে দুলতে লাগলাম। আলো থেকে পালাব নাকি কাছে যাব কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ মনে হলো আমার নাম ধরে কেউ ডাকছে। দাদির কাছে শুনেছি ভ‚তরা নাম ধরে ডাকে। ডেকে নিয়ে তারপর ঘাড় মটকে রক্ত খায়। আমার এক বন্ধু বলল, ‘এটা তো চাচা মিয়ার গলা।’ আমাদের বাড়ির কাজের লোককে আমরা চাচা মিয়া বলে ডাকি। চাচা মিয়া ডাকছে শুনে মনে সাহস ফিরে পেলাম। ভয় আর আনন্দের মিশ্রণে চিৎকার বেরিয়ে এলো আমাদের গলা দিয়ে।
আমাদের চিৎকার লক্ষ্য করে আলোটি এগোতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে নৌকাটি আমাদের কাছাকছি চলে এলো। নৌকা থেকে টর্চ লাইটের আলো এসে পড়ল আমাদের মুখের ওপর। বাবার গলার আওয়াজ পেলাম। আবার ভয়ে আত্মা শুকিয়ে গেল। মনে হলো এবার আর রক্ষা নেই। নিশ্চয়ই যে কাণ্ড ঘটিয়েছি, ভীষণ রেগে আছেন। কিন্তু না, ঘটনা ঘটল উল্টো। আমাদেরকে দেখে বাবার চোখে পানি এসে গেল। তিনি নিজে চাচা মিয়ার নৌকা ছেড়ে আমাদের নৌকায় এসে বৈঠা হাতে নিয়ে নৌকা চালাতে শুরু করলেন। তখনও ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নৌকা এসেছে ঘাটে ভিড়ল, মা দৌড়ে এসেছে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। গরম পানি দিয়ে গোসল করিয়ে ঘরে নিয়ে গরম কাপড় পরতে দিলেন। বাড়ির ঘাটে আমার অন্য বন্ধুদের বাবা-মা, ভাই-বোনরাও অপেক্ষা করছিলেন। তারাও যার যার বাড়ি চলে গেল। আমার জীবনে অনেক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যা এসেছে, আরো আসবে। কিন্তু এই সন্ধ্যার স্মৃতি কোনোদিন ভুলতে পারব না। এটি আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা।
[রা. বো. ১৪, ব. বো. ১০]