ভূমিকা : সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত সামাজিক সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ইভ টিজিং। এটি একটি মারাত্মক অপরাধ, যা আমাদের সমাজকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। এর বিষাক্ত ছোবলের শিকার হয়ে অনেক মেয়ের জীবন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একে আমাদের সমাজে যৌন হয়রানিও বলা হয়ে থাকে। নৈতিক মূল্যবোধ ও মানবিকতাকে বিসর্জন দিয়ে অনেক বখাটে নির্লজ্জের মতো আচরণ করছে ইভ টিজিংয়ে লিপ্ত হয়ে।
ইভ টিজিংয়ের স্বরূপ : খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বাইবেল অনুযায়ী ‘ইভ’ (ঊাব) হচ্ছেন পৃথিবীর আদিমাতা। বর্তমানে এই ‘ইভ’ শব্দটি নারীকে রূপক অর্থে প্রকাশ করতে ব্যবহৃত হয়। আর ‘টিজিং’ (teasing) অর্থ হলো উত্ত্যক্ত করা বা বিরক্ত করা। তাই ইভ টিজিং শব্দটি দ্বারা বোঝায় নারীকে উত্ত্যক্ত করা। আমাদের দেশে একে যৌন হয়রানি হিসেবেও অভিহিত করা হয়ে যাকে। ১৯৭৫ সালে আমেরিকান কর্নেল অ্যাস্টিভিস্টরা সর্বপ্রথম এ শব্দটি ব্যবহার করেন। বিশিষ্টজনদের মতে অশালীন চাহনির মাধ্যমে মেয়েদেরকে উত্ত্যক্ত করা, তাদেরকে দেখে শিস বাজানো, বাজে মন্তব্য করা, অপ্রত্যাশিতভাবে বা আচমকা কোনো মেয়ের সামনে লাফিয়ে পড়া, হঠাৎ হাততালি দেওয়া, বিনা অনুমতিতে ক্যামেরা অথবা মোবাইল দিয়ে মেয়েদের ছবি তোলা, মেয়েদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে মিসড কল বা কল দেওয়া কিংবা মেসেজ পাঠানোর মতো আপত্তিকর কাজগুলো ইভ টিজিংয়ের পর্যায়ে পড়ে। এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মেয়েদের স্বাধীনভাবে চলাফেরায় বাধা সৃষ্টি করা হয়। এগুলো মানসিক বিকৃতিরই বহিঃপ্রকাশ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইভ টিজিং : বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ইভ টিজিং ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আমাদের সংবিধানের ২৭ ও ২৮ নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভের কথা উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ দেখা যায় না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা এখনও অনেক ক্ষেত্রে অসহায়ত্বের শিকার হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা বর্ষবরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পবিত্র শিক্ষাঙ্গনেও ইভ টিজিংয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে মেয়েদের। এখানেই শেষ নয়। স্কুলছাত্রী থেকে শুরু করে আদিবাসী তরুণী কেউই রেহাই পায়নি বখাটেদের হাত থেকে। জ্ঞান প্রদানকারী শিক্ষকও এখন ভক্ষকে পরিণত হয়েছে। নারীরা কোথাও নিরাপদ নয়।
ইভ টিজিংয়ের কারণ : ইভ টিজিং মূলত এক ধরনের মানসিক ব্যাধি। এর পেছনে বিভিন্ন কারণ মুখ্যত দায়ী। এই কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো -
(১) নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় : সময়ের সাথে সাথে যুগের পরিবর্তনে মানুষের চিন্তা-চেতনা আধুনিক হলেও তার নৈতিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের যুবসমাজ বিপথগামী হচ্ছে এবং নৈতিক শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটার কারণে তারা ইভ টিজিংয়ে প্রবৃত্ত হচ্ছে।
(২) দুর্বল আর্থ সামাজিক অবস্থা ও বেকারত্ব : দরিদ্র পরিবারের উঠতি বয়সের ছেলেরা কিংবা বেকার ছেলেরা দিশাহারা হয়ে পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়ায়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে সময় কাটানোর জন্য তারা পার্কে কিংবা রাস্তার মোড়ে জটলা পাকায়। এ সময় তারা বিনোদনের জন্য যেকোনো মেয়েকে দেখলেই ইভ টিজিং করতে থাকে।
(৩) দুর্বল পারিবারিক শিক্ষা : যেসব পরিবারে বাবা-মা তার পুত্রসন্তানকে প্রকৃত শিক্ষা দিয়ে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে তারা ইভ টিজিংয়ের মতো নোংরা কাজে জড়িত হয় না। কিন্তু যেসব পরিবারের কাঠামো দুর্বল এবং সন্তানরা পিতা-মাতার কাছ থেকে যথার্থ শিক্ষা পায় না তারা সহজেই যেকোনো অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে।
(৪) অপসংস্কৃতির প্রভাব : ইভ টিজিংকে উৎসাহিত করতে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি কিংবা অপসংস্কৃতি বিরাট নেতিবাচক প্রভাব রাখছে। টেলিভিশনে নানা ধরনের কুরুচিপূর্ণ অনুষ্ঠান দেখে আজকের যুবসমাজ একে ফ্যাশন বলে মনে করে। ফলে সমাজে ইভ টিজিং বাড়ছে।
(৫) মেয়েদের অশালীন পোশাক পরিধান : বর্তমানকালে আধুনিক ফ্যাশনের নামে মেয়েদের অশালীন নানা পোশাক পরিধান করতে দেখা যায়। এসব পোশাক প্রকারান্তরে ছেলেদেরকে ইভ টিজিংয়ে প্ররোচিত করে, যা অত্যন্ত ক্ষতিকর।
উপর্যুক্ত নানা কারণে ইভ টিজিং সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে।
ইভ টিজিং প্রতিরোধে করণীয় : ইভ টিজিং প্রতিরোধে সকলের সচেতন অবস্থান তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এর পাশাপাশি আরও নানা করণীয় রয়েছে আমাদের। এগুলো হলো-
(১) মেয়েদেরকে মজবুত মানসিকতার অধিকারী করে গড়ে তুলতে হবে
(২) তরুণ ছেলেদের মনে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করতে হবে।
(৩) পাঠ্যপুস্তকগুলোতে ইভ টিজিংয়ের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরতে হবে।
(৪) ইভ টিজিংয়ের শিকার হওয়া যেকোনো মেয়েকে পরিবার থেকে সহানুভূতি ও ভালোবাসা দিতে হবে।
(৬) পাশ্চাত্য সংস্কৃতি কিংবা অপসংস্কৃতির প্রভাব থেকে তরুণ প্রজন্মকে বাঁচানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
(৬) পাশ্চাত্য সংস্কৃতি কিংবা অপসংস্কৃতির প্রভাব থেকে তরুণ প্রজন্মকে বাঁচানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
(৮) নারী-পুরুষ সকলকে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার শিক্ষা দিতে হবে। এর মাধ্যমে তারা সুশৃঙ্খল জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ হবে, যা ইভ টিজিংয়ের মতো অনৈতিক কাজকে নিরুৎসাহিত করবে।
(৯) ইভ টিজিংবিরোধী সভা-সমাবেশ ও সেমিনারের আয়োজন করা।
(১০) প্রচারমাধ্যমগুলোতে ইভ টিজিং প্রতিরোধে অনুষ্ঠান আয়োজন।
ইভ টিজিং প্রতিরোধে সরকার গৃহীত পদক্ষেপ : ইভ টিজিং প্রতিরোধে সরকারের পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে-
(১) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের বিচারিক ক্ষমতার তত্তাবধানে ভ্রাম্যমাণ আদালত ব্যবস্থা গৃহীত হয়। এতে ৫০৯ ধারা সংযোজন করে তাৎক্ষণিকভাবে বখাটেদের শাস্তি দেওয়ার বিধান রাখা হয়।
(২) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন, ২০১০’ এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে।
উপসংহার : ইভ টিজিং একটি ভয়ংকর সামাজিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এ সমস্যা সমাধানকল্পে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জনগণ এবং সরকার উভয়ের সম্মিলিত উদ্যোগই পারে ইভ টিজিংকে কঠোর হাতে দমন করতে। আমাদের সমাজকে ইভ টিজিং থেকে রক্ষা করতে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। তাই সকলকে সচেতন হতে হবে এবং প্রতিবাদ করতে হবে ইভ টিজিংয়ের বিরুদ্ধে।