সূচনা : পৃথিবীতে নির্মল আনন্দের যে কয়েকটি উৎস রয়েছে তার মধ্যে বই অন্যতম। বই পড়লে জ্ঞানী ব্যক্তির জ্ঞানের তৃষ্ণা মেটে। বই পাঠের মাধ্যমে মানুষ অনাবিল শান্তি খুঁজে পায়। অনুসন্ধিৎসু মানুষের বিচিত্র অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানা যায় বই পাঠ করে। সুসময় হোক কিংবা দুঃসময়, বই কখনো মানুষকে ছেড়ে যায় না। তাই আবহমানকাল ধরে মানুষ বইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে আসছে। তাই তো বিশ্বকে জানতে কবিগুরু লিখেছেন -
মানবজীবনে বইয়ের অবদান : মানবজীবনে বইয়ের অবদান অপরিসীম। বই পড়ার মাধ্যমেই মানুষ জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে পারে। যে ব্যক্তি যত বেশি বই পড়বে তার জ্ঞানের ভাণ্ডার তত বেশি সমৃদ্ধ হবে। প্রখ্যাত দার্শনিক টলস্টয়ের উক্তিটি এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, “জীবনে তিনটি বস্তুই বিশেষভাবে প্রয়োজন, তা হচ্ছে বই, বই এবং বই।” বই মানুষের মন ও দৃষ্টিভঙ্গিকে উদার করে। জীবনের আসল রহস্য উন্মোচনে এবং নিজেকে বৃহত্তর জগতের সঙ্গে সংযুক্ত করতে উৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবে বইকেই বেছে নিতে হবে। মানুষের রোগ-শোক, দুঃখ-কষ্ট, হতাশা-বিষাদ সবকিছুই পুস্তক পাঠের মাধ্যমে দূরীভ‚ত করা যায়। বিশ্বের মহামূল্যবান গ্রন্থগুলো পৃথিবীরে বিচিত্র জ্ঞানের ভাণ্ডার। মানবজীবনকে সার্থক করে তুলতে চাইলে জ্ঞান আহরণ করা জরুরি। আর এক্ষেত্রে সহায়তাকারী বন্ধু হিসেবে ভ‚মিকা রাখতে পারে বই। তাই মানবজীবনে বইয়ের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
জ্ঞানের আধার হিসেবে বই : মানুষের অর্জিত বিভিন্ন জ্ঞানের প্রতিফলন ঘটেছে বইয়ের পাতায়। আমাদের চারপাশে জ্ঞানের বিভিন্ন উৎস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। নানা বিষয়ের সকল জ্ঞানকে আমরা পুস্তক পাঠের মাধ্যমেই আত্মস্থ করতে পারি। অতীত কিংবা ভবিষ্যতের জ্ঞান, সাহিত্য, ভ‚গোল, আইন, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ের অজানা তথ্য আমরা জানতে পারি বই পড়ার মাধ্যমে। এক্ষেত্রে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, “মানুষ বই দিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সাঁকো বেঁধে দিয়েছে।” “মানুষ বই পড়ার মাধ্যমে সকল কালের সকল মনীষীর সংস্পর্শে আসতে পারে। তাঁরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাঁদের রচিত নানা ধরনের বই পাঠ করে আমরা জীবনকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে সক্ষম হই।
চিত্ত প্রসারণে ও বুদ্ধির বিকাশ সাধনে বই : বই পড়ার উপকারিতার কথা বলাই বাহুল্য। বই কেবল নির্মল আনন্দের খোরাকই জোগায় না, মনের সংকীর্ণতাকে দূর করে বুদ্ধির বিকাশ ঘটাতেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। আনাতোল্ ফ্রাঁস বই পড়ার আনন্দে অভিভূত হয়ে বলেছিলেন -
বই পড়লে আমাদের মনের দিগন্ত উন্মোচিত ও প্রসারিত হয়। আমাদের মনে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে অজ্ঞানতার অন্ধকারকে দূর করে দেয়। প্রকৃত মানুষ হওয়ার অন্যতম শর্ত হলো যথার্থ জ্ঞানী হওয়া। আর প্রকৃত অর্থে জ্ঞানী হতে হলে চিত্তের প্রসারণ এবং বুদ্ধির বিকাশ উভয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে বই-ই মানুষের চিত্ত ও বুদ্ধির বিকাশের জন্য যথেষ্ট। রাশিয়ার বিখ্যাত সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কির মতে, “আমার মধ্যে উত্তম বলে যদি কিছু থাকে তার জন্য আমি বইয়ের কাছেই ঋণী।” তাই আমাদের চিত্তের প্রসারণ এবং বুদ্ধির স্বাধীনতার জন্য বই পাঠ করা জরুরি।
বহির্বিশ্বের সাথে সংযোগ স্থাপনে বইয়ের ভূমিকা : ভ্রমণের মাধমে নানা দেশের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, মানুষ ইত্যাদি সম্পর্কে জানা যায়। কিন্তু কথায় আছে, ‘সাধ থাকলেও সাধ্য নেই’। মানুষের ক্ষেত্রে এ সত্যটি বেশ স্পষ্টভাবেই ধরা পড়ে। সে ইচ্ছে করলেই তার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পারে না। তাই তার পৃথিবী ভ্রমণের ইচ্ছা অধরাই থেকে যায়। তবে জ্ঞানপিপাসু লোকদেরকে অর্থের সীমাবদ্ধতা আটকে রাখতে পারে না। যারা ভ্রমণের ইচ্ছাকে হৃদয়ে লালন করে তাদের কাছে বই হতে পারে সকল সুখের চাবিকাঠি। একটি উত্তম বই বহির্বিশ্বের সাথে মানুষের যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারে। ঘরে বসেই সে জানতে পারে নিজের দেশকে এবং বহির্বিশ্বকে। এর মাধ্যমে সে আনন্দ লাভ করে এবং জ্ঞানতৃষ্ণাকে তৃপ্ত করে। বহির্বিশ্বকে মানুষ তার হাতের মুঠোয় আনতে পারে বই পড়ার মাধ্যমে। তাই বহির্বিশ্বের সাথে মানুষের সংযোগ স্থাপনে বইয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
বই পড়ার আনন্দ : মানুষ মাত্রই জগতের অফুরন্ত আনন্দের অংশীদার হতে চায়। কিন্তু জীবনে চলার পথে মানুষকে ঘিরে ধরে নানা দুঃখ-কষ্ট, হতাশা ও বিষাদ। এসব থেকে মুক্তি দিতে বই মানুষের জীবনে পথ্যের মতো কাজ করে। মনীষী বারট্রান্ড রাসেল বলেছেন, “সংসারে জ্বালা-যন্ত্রণা এড়ানোর প্রধান উপায় হচ্ছে মনের ভেতর আপন ভুবন তৈরি করে নেওয়া এবং বিপদকালে তার ভেতর ডুব দেওয়া। যে যত বেশি ভুবন তৈরি করতে পারে, ভবযন্ত্রণা এড়ানোর ক্ষমতা তার তত বেশি হয়।” এই ভুবন সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ ভ‚মিকা রাখতে পারে বই। বই পড়ার আনন্দ নির্মল ও নিষ্কলুষ। মানুষকে সকল সংকীর্ণতা, অজ্ঞানতা এবং সংশয়ের ঊর্ধ্বে নিয়ে যায় বই। বই পড়লে মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি জেগে ওঠে এবং মানুষ অনাবিল আনন্দের সংস্পর্শে আসতে পারে। এ কারণেই কবি ওমর খৈয়াম বইকে ভাবতেন নিঃসঙ্গ জীবনের সহচর রূপে। নির্মল আনন্দ পাওয়ার যে কয়েকটি উৎস রয়েছে তা অনুসন্ধান করা মানুষের পক্ষে খুব সহজ নয়। কিন্তু বই সবসময় হাতের কাছেই পাওয়া যায়। তাই বই পড়ে আনন্দ লাভ করা তুলনামূলকভাবে সহজ। বই পড়ে জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি আনন্দ অনুসন্ধান করা বুদ্ধিমান ব্যক্তিরই কাজ।
পাঠ উপযোগী বইয়ের স্বরূপ : বই নির্মল আনন্দ ও নিষ্কলুষ জ্ঞানের সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলেও সব বইয়ের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। কেবল উৎকৃষ্ট মানের বই-ই মানুষের শ্রেষ্ঠ সঙ্গী হওয়ার দাবিদার। পাঠককে তাই সঠিক বই নির্বাচনের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। যদি তার পছন্দ সঠিক হয় তবেই সে বই পাঠের প্রকৃত উপকার লাভ করতে পারবে। কুরুচিপূর্ণ ও অশ্লীল বই আমাদের যুবসমাজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায় এবং তাদের জ্ঞানকে করে আড়ষ্ট। যেসব বই বাস্তব জ্ঞান, নৈতিকতা, সামাজিকতা, জীবনাচার, সংস্কৃতি, দেশপ্রেম ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে ধারণা দেয় সেগুলোই পাঠ উপযোগী বই। এর পাশাপাশি বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী, ভ্রমণকাহিনিমূলক বই, গোয়েন্দা কাহিনিনির্ভর বই, ইতিহাস, আইন ইত্যাদি বিষয় সংক্রান্ত বইও পাঠ করা যায়। সাধারণত বই পড়ার অভ্যাস যদি ছোটবেলা থেকেই গড়ে তোলা যায় তবে তা ভবিষ্যতে কার্যকরী ভ‚মিকা রাখতে পারে। সেক্ষেত্রে শিশুর পিতা-মাতাকে সঠিক ভ‚মিকা পালন করতে হবে। তাদের বই নির্বাচনের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। বিভিন্ন শিশুতোষমূলক গ্রন্থ পাঠ করানোর মাধ্যমে শিশুর মেধার বিকাশ ঘটানো যায়। বই নির্বাচন যদি সঠিক হয় তবে জ্ঞান আহরণের উদ্দেশ্য সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা যায়।
উপসংহার : একটি বই আবহমানকাল ধরে মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে। আনন্দপ্রাপ্তি এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য বই মানুষের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। একটি উত্তম বই মানুষের মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তুলতে সক্রিয় ভ‚মিকা রাখে। তাই পরিপূর্ণ আত্মিক তৃপ্তি লাভে বই পড়ার গুরুত্ব অপরিসীম।
[রা. বো. ১৪, দি. বো. ১৪, কু. বো. ১৩]