ভূমিকা : বাংলাদেশের এই সবুজ ভূখণ্ডে মাঝে মাঝেই আঘাত হানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। নিয়মিত বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাসের ভয়াবহতায় আমরা প্রতিবছরই ক্ষতিগ্রস্ত। প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহের মধ্যে ভূমিকম্প আতঙ্কই আমাদের মাঝে সর্বাধিক দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করে। কারণ ভূমিকম্প কোনো রকম পূর্ব সংকেত ছাড়াই ভূপৃষ্ঠকে কাঁপিয়ে দেয়। বেশ কয়েক বছর ধরে অনেকগুলো মৃদু থেকে মাঝারি ভূমিকম্প আমাদের দেশে আঘাত হেনেছে। হাইতির পর সাম্প্রতিককালে নেপালের ভূমিকম্প আমাদের উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
ভূমিকম্প কী এবং কেন : ভূত্বক পরিবর্তনকারী প্রক্রিয়াসমূহ প্রতিনিয়ত ক্রিয়াশীল। কোনো কারণে ভূঅভ্যন্তরের বিপুল শক্তি দ্রুত মুক্ত হওয়ার সময় ভৃপৃষ্ঠে যে প্রবল ঝাঁকুনি বা কম্পনের সৃষ্টি হয় তাকে ভূমিকম্প বলে। ভূমিকম্পের তীব্রতা অনুযায়ী পৃথিবীর এক প্রান্তে অবস্থিত ভূমিকম্পনকেন্দ্র থেকে সৃষ্ট তরঙ্গমালা পৃথিবীর অপরপ্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। অবশ্য কেন্দ্র হতে তরঙ্গগুলো যতই দূরে অগ্রসর হয়; ততই নিস্তেজ হয়ে পড়ে। মৃদু কিংবা প্রবল ভূমিকম্প মাপার এককের নাম রিখটার স্কেল। ভূমিকম্পের কারণ অনুসন্ধানকালে ভূতত্তবিদগণ লক্ষ করেন, পৃথিবীর কয়েকটি বিশেষ অঞ্চলে অধিক ভূমিকম্প সংঘটিত হয়।
বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে : বাংলাদেশের ভূখণ্ডে মোট ৮টি ভূচ্যুতি এলাকা ক্রিয়াশীল। এগুলো হচ্ছে বগুড়ার তানোর, ত্রিপুরা, সীতাকুন্ড-টেকনাফ এলাকা, হালুয়াঘাট, ধুবরি, চিটাগাং, শাহীবাজার এবং রাঙামাটি। এসব ভূচ্যুতির জন্য বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। এ ছাড়া ইন্ডিয়া-ইউরেশিয়া-বার্মা টেকটোনিক প্লেটের সীমান্তবর্তী এলাকার নিকটে বাংলাদেশের অবস্থান। হিমালয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে এই টেকটোনিক প্লেট বন্ধ হয়ে আছে। ফলে এটি শক্তি সঞ্চয় করছে। যখন সেই শক্তির কাছে এ টেকটোনিক প্লেট বন্ধনমুক্ত হবে, তখন শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। যা বাংলাদেশ, উত্তর ভারত ও মায়ানমারে মারাত্মক আঘাত হানতে পারে। জানুয়ারি ২০০৬-ডিসেম্বর ২০০৯ এ তিন বছরে ৪ রিখটার স্কেলের ওপরের মাত্রার ১১৫টি ভূমিকম্প রেকর্ড করেছে। এছাড়াও ৫ রিখটার স্কেলের আরও দশটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে এ সময়ে। বঙ্গোপসাগরে চারটি ভূমিকম্পের উৎস ক্রিয়াশীল থাকায় এ অঞ্চলগুলো সুনামিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে।
বাংলাদেশে ভূমিকম্পের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : বাংলাদেশে ১৫৪৮ সাল থেকে সংঘটিত ভূমিকম্পসমূহের তথ্য সংরক্ষিত আছে। ভূমিকম্পের এ তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯০০ সাল থেকে প্রায় ১০০টি মাঝারি থেকে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে, যার মধ্যে ৬৫টি আঘাত হেনেছে ১৯৬০ সালের পর থেকে। এ তথ্য থেকে আরও জানা যায় গত ত্রিশ বছরে দেশে ভূমিকম্পের হার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আমাদের দেশের জন্য অশনী সংকেত।
ভূমিকম্পে ক্ষতক্ষতির কারণ ও পরিমাণ : ভূমিকম্পের সময় মাটির তারল্যিকরণ ঘটে এবং মাটির ধারণক্ষমতা কমে যায়। ফলে বড় বড় ভবনগুলোকে মাটি ধরে রাখতে পারে না। যে কারণে সেগুলো ধ্বংসের মুখে পতিত হয়। ইউএআইডি ঢাকা শহরে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির কারণ বিশ্লেষণ করেছে, যা প্রায় ক্ষেত্রে সারা বাংলাদেশের শহরগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এগুলো নিম্নরূপ-
১. ভূমিকম্পের পরপরই কী করণীয়- এ সম্বন্ধীয় জ্ঞানের অভাব রয়েছে। ফলে ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি পেতে পারে।
২. শহরের বেশিরভাগ বিল্ডিং ভাসমান অথবা কম গভীর ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, ফলে এগুলো দেবে যেতে পারে।
৩. বর্ষার সময় যদি ভূমিকম্প হয় তবে মাটিতে পানির পরিমাণ বেশি থাকায় ধ্বংসযজ্ঞ ভয়াবহ রূপ লাভ করতে পারে।
৪. গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, যা ভূমিকম্প-পরবর্তী পুনর্বাসন কর্মসূচিতে ব্যাঘাত ঘটাবে।
৫. রাস্তা-ঘাট-ব্রিজ-কালভার্ট ভেঙে গিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস হতে পারে।
৬. পুরাতন ও নিম্নমানের স্কুল-ভবন ভেঙে অনেক ছাত্রছাত্রীর মৃত্যু ঘটতে পারে। যার ফলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ লাভ করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে ৭.৫ মাত্রার একটি বড় ভূমিকম্প ঢাকা শহরে লক্ষাধিক মানুষ এবং প্রায় ৭২,০০০ ভবন ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আর বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অবস্থা আরও বেশি খারাপ।
ভূমিকম্প মোকাবেলায় আমাদের করণীয় : ভূমিকম্প এক ধ্বংসাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ যার পূর্বাভাস দেওয়ার মতো কোনো প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়নি। এ কারণে ভূমিকম্পে যাতে অধিক জানমালের ক্ষতি না হয় সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। সরকার অনুমোদিত বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ করতে হবে। ভূমিকম্পের পরবর্তী সময়ে যেন খাদ্য, পানীয় ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায় সেদিকে সরকারকে বিশেষ নজর দিতে হবে। তবে সরকারের একার পক্ষে এ ধরনের মহাবিপর্যয় মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। বিভিন্ন দাতাসংস্থা ও এনজিও এক্ষেত্রে নানা ভূমিকা পালন করতে পারে। দাতাসংস্থাগুলো ভূমিকম্প মোকাবেলায় সরকার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সহযোগিতা করতে পারে। ভূমিকম্পের ওপর যে উন্নত প্রযুক্তি বিদেশে উদ্ভাবিত হয়েছে, আমাদের দেশের প্রকৌশলীদের সে বিষয়ে সম্যক জ্ঞাত করতে হবে।
ভূমিকম্প মোকাবেলায় বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা : ২০১০ সালে ভূমিকম্পের পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করতে ৪০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সরকার। ৬০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বড় মাত্রার ভূমিকম্পের জন্য এ প্রস্তুতি বড়ই অপ্রতুল। বড় কোনো বিপর্যয় মোকাবেলা করার মতো সামর্থ্য এখনও তৈরি হয়নি আমাদের।
উপসংহার : ভূমিকম্প পৃথিবীর সবচেয়ে আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এটি একটি দেশের আবাসিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়। আমাদের মতো দরিদ্র দেশে ভূমিকম্প তাই অভিশাপের দ্বিতীয় নাম। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীর ভূমিক¤পপ্রবণ এলাকাগুলোর মধ্যে। এ কারণে অপ্রত্যাশিত হলেও বড় ধরনের ভ‚মিকম্পের ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ।