ভূমিকা : শৃঙ্খলা বা নিয়মানুবর্তিতার মাঝেই লুকিয়ে আছে মুক্তি আর সাফল্যের চাবিকাঠি। এই মহাবিশ্ব অনন্তকাল ধরে চলছে সুশৃঙ্খলভাবে নিয়মের ছকে। পৃথিবী, চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, তারা নিজ নিজ কক্ষপথে চলছে সুশৃঙ্খলভাবে। এর একটু ব্যত্যয় ঘটলেই শুরু হবে মহাপ্রলয়। শৃঙ্খলা আর নিয়মের সমষ্টিই হলো এই জীবন আর জগতের অস্তিত্ব।
নিয়মানুবর্তিতা কী? মানুষ সামাজিক জীব বিধায় সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে হলে অবশ্যই কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। নিয়মের কারণেই মানুষ সমাজ সৃষ্টি করে একত্রে বসবাস করতে অভ্যস্ত হয়েছে। সমাজজীবনে যেমন ব্যক্তিজীবনেও তেমনি নিয়মানুবর্তিতা প্রয়োজন। জগতের প্রতিটি কাজের জন্যই রয়েছে সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন। এ নিয়মকেই বলা হয় শৃঙ্খলা। নিয়ম মেনে সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করাকেই নিয়মানুবর্তিতা বলে। ব্যক্তির কল্যাণে, জাতির কল্যাণে এবং দেশের কল্যাণে নিয়মানুবর্তিতা প্রয়োজন। নিয়মানুবর্তিতা শৃঙ্খলাবোধের জন্ম দেয় এবং মানুষকে কর্তব্য পালনে সচেতন করে তোলে। আমরা যদি বাল্যকাল হতেই নিয়মানুবর্তিতা শিক্ষা লাভ করি, তাহলে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা কষ্টকর নয়।
নিয়মানুবর্তিতা সফলতার সিঁড়ি : একজন মানুষ নিয়মানুবর্তিতার সিঁড়ি বেয়েই সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে পৌঁছতে পারে। আর সত্যিকারের আনন্দ সফলতা ছাড়া আসে না। শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনই আসলে সত্যিকার আনন্দের, উপভোগ্য জীবন। শৃঙ্খলাহীন ও পরিকল্পনাহীন আনন্দ বা বিনোদনের মানে উচ্ছৃঙ্খল জীবন। যার পরিণতি বিষণ্নতা, একঘেয়েমি, বিরক্তি। শৃঙ্খলা ছাড়া সাফল্য দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয়। সুশৃঙ্খল জীবনের গুরুত্ব কবির ভাষায়,
প্রকৃতি জগতে শৃঙ্খলা : শৃঙ্খলা প্রাকৃতিক, বিশৃঙ্খলা কৃত্রিম। মহাবিশ্বের সর্বত্র শৃঙ্খলা বিরাজমান। সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহ, নক্ষত্র নিজ নিজ কক্ষপথে চলছে। তাদের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ নেই, কোনো বিরোধ নেই। আমাদের শরীরট্ওা শৃঙ্খলার বন্ধন মেনে চলছে। যেমন- ফুসফুস, হৃদপিণ্ড একই ছন্দে ২৪ ঘণ্টা কাজ করে যাচ্ছে। খাবারের পুষ্টি স্বয়ংক্রিয়ভাবে রক্তের মাধ্যমে কোষে কোষে পৌঁছে যাচ্ছে। পাকস্থলী খাবার হজম করছে। এই কাজগুলোর মধ্যে কোনো বিরতি নেই, বিশৃঙ্খলা নেই, কোনো সিস্টেম লস নেই। একটু অনিময় করলেই শরীর বিদ্রোহ করে। আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি।
ছাত্রজীবনে নিয়মানুবর্তিতা : ছাত্রজীবন হলো মানবজীবনের ভিত্তি গড়ার সময়। ছাত্রজীবনের শিক্ষার আলোকে একজন মানুষের বাকি জীবন পরিচালিত হয়। কর্মজীবনেও তার প্রভাব থাকে। লেখাপড়ার সাথে সাথে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একজন ছাত্রকে বিশেষ কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। এই নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার প্রতি যে ছাত্র যত বেশি নিষ্ঠাবান ও আন্তরিক থাকে সে ছাত্রজীবনে যেমন সফল হয় কর্মজীবনেও সাফল্যের বিজয়মালা তার গলায় শোভা পায়।
নিয়মানুবর্তিতা ভঙ্গের কারণ : প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে মানুষ ইচ্ছা ও পছন্দের স্বাধীনতার অপব্যবহার করে নিয়মানুবর্তিতা ভেঙে নিজেই নিজের সর্বনাশ যেভাবে করে তা তুলে ধরা হলো :
১. খেয়ালিপনা : সাময়িক সুখ ভোগের জন্য মানুষ খামখেয়ালিপনার মাধ্যমে বাস্তবতাকে ভুলে থাকতে চায়। কিন্তু এর মাধ্যমে বাস্তবতাকে ভুলে থাকা বা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। যেকোনো বিপদ-আপদে ধৈর্যধারণ করে সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করলে সাফল্য একদিন আসবেই এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু উদ্দেশ্যহীনতায় ভেসে বেড়ানো কিংবা যা খুশি তাই করার মধ্য দিয়ে একজন মানুষ অনুসরণীয় আদর্শ হতে পারবে না।
২. পরিকল্পনাহীন জীবন : একটি সুন্দর পরিকল্পনা হচ্ছে যেকোনো কাজ সুন্দরভাবে শেষ করার অর্ধেক। পরিকল্পনা ছাড়া অনেক কাজ হয় তো করা যায়। কিন্তু কাজের ফসল পরিপূর্ণভাবে ঘরে তোলা যায় না। তাই সুশৃঙ্খল জীবনের জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা। পরিকল্পনাহীন জীবন ব্যর্থতাকেই ডেকে আনে।
৩. সময়ের মূল্য বুঝতে না পারা : এই পৃথিবীতে প্রতিটি কাজের একটি উদ্দেশ্য, একটা কাল ও একটা সময় আছে। সঠিক সময়ে সঠিক কাজ শেষ করতে হবে তা না হলে শেষে কাঁদলে কাজ হবে না। এই উপলব্ধির অভাবে মানুষ বিশৃঙ্খলভাবে সময় নষ্ট করে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সর্বনাশ ডেকে আনে।
নিয়মানুবর্তিতার গুরুত্ব : পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, জাতীয় জীবন অর্থাৎ জীবনের সব ক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তিতার গুরুত্ব অপরিসীম। কলকারখানা, দোকান, খেলার মাঠ, হাসপাতাল, সর্বত্রই নিয়মানুবর্তিতা একান্ত প্রয়োজন। নিয়ম-শৃঙ্খলা না থাকলে কোনো প্রতিষ্ঠানই গড়ে উঠতে পারে না। সুশৃঙ্খল নিয়ম জাতিকে উন্নত করে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাব যে, সুশৃঙ্খল নিয়মই তাদের উন্নতির প্রধান কারণ। নিয়মের অভাবের ফলে ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় জীবনও বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে অস্তিত্বও বিপন্ন হতে পারে। তাই মানুষের জীবনে নিয়মানুবর্তিতার গুরুত্ব অপরিসীম।
নিয়মানুবর্তিতা ফিরিয়ে আনার উপায় :
১. কাজের পরিকল্পনা করতে হবে : গুরুত্ব অনুসারে প্রতিদিনের কাজের তালিকা তৈরি করে সবার আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করতে হবে। ধীরস্থিরভাবে একে একে কাজগুলো শেষ করলে সঠিক সময়ে সঠিক কাজ শেষ হবে। কাজে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।
২. আজকের কাজ কালকের জন্য ফেলে রাখা যাবে না : প্রতিদিনই মানুষের কিছু না কিছু কাজ করতে হয়। তাই প্রতিদিনের কাজ প্রতিদিন শেষ করার অভ্যাস করতে হবে। তা না হলে ধীরে ধীরে কাজের বোঝা বেড়ে যাবে। অলসতা ও ভয় ঘিরে ধরে ব্যর্থতাকে ডেকে আনবে।
৩. অলসতা পরিহার করতে হবে : কবির ভাষায়,
অলস লোকদের জীবনে কোনো শৃঙ্খলা থাকে না। অলসতা আর সফলতা একসাথে থাকতে পারে না। তাই জীবনে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা ফিরিয়ে আনতে হলে অলসতাকে ঝেড়ে ফেলতে হবে।
৪. কঠোর পরিশ্রমী হতে হবে : শুধু অলসতা পরিত্যাগ করলেই হবে না। সাথে সাথে কঠোর পরিশ্রমীও হতে হবে। শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতাপূর্ণ জীবন অনুশীলন ছাড়া হঠাৎ অর্জন করা যায় না। অনুশীলন কঠোর পরিশ্রমের বিষয়।
৫. অধ্যবসায়ী হতে হবে : অধিকাংশ মানুষের বড় সমস্যা হলো তারা কাজ শুরু করে কিন্তু লেগে থাকতে পারে না। উল্টা-পাল্টা চিন্তা এবং অলসতা তাকে গ্রাস করে। এই জাল ছিন্ন করতে নিজেকে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ হতে হবে। তাহলে সাফল্য একদিন আসবেই।
উপসংহার : কথায় আছে, সাধনায় অসাধ্য লাভ হয়। বিনা সাধনায় কিছুই পাওয়া যায় না। জীবনকে নিয়মানুবর্তিতার ছকে পরিচালনা করার জন্য অবশ্যই কঠোর সাধনা করতে হবে। শাস্তির ভয়ে নয়, সুখী-সমৃদ্ধশালী জীবন গড়ার প্রত্যাশায় আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শৃঙ্খলাবোধ ও নিয়মানুবর্তিতায় অভ্যস্ত হতে হবে। শাস্তি দিয়ে সাময়িক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা গেলেও সুযোগ পেলেই মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তখন অতীতের সকল অর্জন রসাতলে যায়। তাই ইতিবাচক বোধ থেকেই উন্নত জীবন গঠন করে মানবসমাজে নিজেকে অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করতে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার চর্চা করতে হবে।