ভুমিকা : বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণে-অকারণে নিত্যপণ্যের দাম বর্তমানে বেড়েই চলেছে। ফলে জনজীবন তীব্র ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। ক্রমাগত পণ্যমূল্য বৃদ্ধি জনজীবনে অসন্তোষ, ক্রোধ ও বিদ্বেষ পুঞ্জীভূত করে। বর্তমান সমাজজীবনে ধর্মঘট, আন্দোলন এগুলোর পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অভাব ও দরিদ্রতাই দায়ী। আর দরিদ্রতার মূলে রয়েছে পণ্যমূল্যের বৃদ্ধি। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আজ আমাদের সামাজিক, জাতীয় ও অর্থনৈতিক জীবনে এক বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দ্রব্যমূল্যের সাথে জীবনযাত্রার সম্পর্ক : দ্রব্যমূল্যের সাথে জীবনযাত্রার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে সমাজের দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। মানুষকে প্রতিদিনই নানাবিধ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে হয়। আর এরূপ কেনাকাটা যদি তার আয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় তবে তার দুরবস্থার সীমা থাকে না। আমাদের দেশের বেশিরভাগ শ্রমিক কর্মচারীর আয় সামান্য। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে এ সীমিত আয় দ্বারা জীবন নির্বাহ তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তখন সাধ ও সাধ্যের ব্যাপক ব্যবধানে জীবনে নেমে আসে দুর্ভোগ ও হতাশা। পক্ষান্তরে, দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল থাকলে তাদের জীবনে থাকে স্বস্তি
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ : বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য বৃদ্ধির নানাবিধ কারণ রয়েছে। তবে উৎপাদন অব্যবস্থাপনাই যে এর মূল কারণ এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যহীনতা। ফলে সীমাবদ্ধ জিনিসের জন্য অগণিত ক্রেতার ভিড় এবং পরিণামে মূল্যবৃদ্ধি ও জিনিস সংগ্রহের জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা। বস্তুত, মজুতদারেরাই নিজেদের লাভের জন্য জিনিসপত্রের দাম চড়িয়ে দেয় এবং তাদের দেখাদেখি ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফার পথ বেছে নেয়।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষতিকর দিক : দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব সবটাই জনগণের ওপর পতিত হয়। জীবনের দৈনন্দিন প্রয়োজনে কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রাদি ক্রয় করতে হয়। দেশের অধিকাংশ মানুষ স্বল্প আয়ের মধ্যে জীবন যাপন করে এবং তাদের পক্ষে অতিরিক্ত মূল্যে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করা প্রায় অসম্ভব। ফলে বাধ্য হয়ে তারা ব্যয় বরাদ্দ কমাতে থাকে। বাজারে জিনিসের দাম বাড়ছে তাতে শিশুদের ভোগ্যপণ্য ক্রয়ের পরিমাণ কমছে। ফলে শিশুদের ওপর যে প্রভাব পড়ে তাতে তাদের স্বাস্থ্য ঠিক থাকে না, তারা অপুষ্টির শিকার হয়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে যে আর্থিক সংকটের সৃষ্টি হয় তাতে ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনেও প্রভাব পড়ে খাদ্য, পোশাক, শিক্ষা উপকরণ ইত্যাদির অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিজনিত আর্থিক সংকট কাটানোর জন্য অনেকে অবৈধ উপার্জনের দিকে মনোযোগী হয়। ফলে সমাজে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধের উপায় : নানা কারণে আজও আমাদের এই দরিদ্র দেশটিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য বেড়েই চলছে। তাই যথাশীঘ্র সম্ভব এই দুষ্ট রাহু থেকে মুক্তির জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এই উদ্দেশ্যে বাজারে চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পণ্যের জোগান নিশ্চিত করতে হবে। কল-কারখানার উৎপাদন নিয়মিত করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি প্রক্রিয়ায় যাতে বিঘ্ন না ঘটে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য মজুদদারি ও কালোবাজারি দূর করতে হবে। মুদ্রাস্ফীতি যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। অসাধু ও ফটকা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। সর্বোপরি সামগ্রিক বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে এবং কেউ যেন হঠকারী সিদ্ধান্ত দিয়ে দ্রব্যের মূল্যকে প্রভাবিত করতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। তবে শুধু সরকারের একার পক্ষে এর সমাধান দেওয়া কঠিনতর ব্যাপার। সরকারের পাশাপাশি সচেতন জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং অসাধু মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের নৈতিকতাবিরোধী কার্যক্রম পরিহারই এই সমস্যার আশু সমাধান দিতে পারে।
উপসংহার : দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে দেশের সাধারণ মানুষের দুর্দশা বাড়বে। কিন্তু আমাদের দেশের এই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। দেশের সাধারণ মানুষের দিকে তাকিয়ে এই দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরতে হবে। সর্বোপরি বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে যেভাবে জিনিসের দাম বেড়েছে তার সঠিক প্রতিরোধ আমাদের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও তার ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য সব নাগরিককে আদর্শ দেশপ্রেমিক হতে হবে, দেশকে ভালোবাসতে হবে এবং উৎপাদন বাড়িয়ে নিজস্ব দ্রব্যাদি ব্যবহার করতে হবে।
[সি. বো. ১২, ব. বো. ১০]