সূচনা : কাজেই মুক্তি। কাজই সমৃদ্ধি। কর্মহীন জীবন কফিনে ঢাকা লাশ। মানুষের দুটি হাতকে দক্ষ কর্মীর হাতে পরিণত করলে সমৃদ্ধি আসবেই। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য, এই আধুনিক যুগে মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ জনশক্তিতে পরিণত হয় না। কর্মহীন বেকার জীবনের অভিশাপ বয়ে বেড়ায়। বিপুল জনসংখ্যার আর সীমিত সম্পদের কারণে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ বিশ্বমানচিত্রে পরিচিত। এই জনসংখ্যাকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে পারলে তাদের দুই হাতের ছোঁয়ায় দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরবে, আসবে সমৃদ্ধি। এজন্য প্রয়োজন বেকারত্বের অভিশাপমুক্ত দেশ।
বেকারের সংজ্ঞা : সাধারণ অর্থে, যার কোনো কাজ নেই তাকে বেকার বলা হয়। কিন্তু অর্থনীতির পরিভাষায় কর্মহীন মানেই বেকার নয়। যদি কোনো ব্যক্তির কাজ করার যোগ্যতা ও ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও কর্মসংস্থান বা কাজের সুযোগ না পান তবে অর্থনীতির পরিভাষায় তিনিই বেকার। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, বেকারত্ব এমন এক সামাজিক অবস্থার নাম যখন সমাজের যথেষ্ট কর্মক্ষম ব্যক্তির বিপরীতে কর্মের সুযোগ থাকে খুবই কম।
বাংলাদেশের বেকারত্বের চিত্র : বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এখানে পর্যাপ্ত শিল্প-কারখানা নেই। বেসরকারি কর্মসংস্থান ও সরকারি চাকরির সীমিত সুযোগের কারণে এ দেশে কর্মক্ষম অধিকাংশ মানুষ কাজ খুঁজে পাচ্ছে না। পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে কর্মক্ষম লোকের ২৭.৯৫ শতাংশ বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত। বাংলাদেশের বেকারত্ব সমস্যার একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো জনসংখ্যার একটি বড় অংশ মৌসুমি বা প্রচ্ছন্ন বেকার। যাদের সারা বছর কাজ থাকে না, বছরের বিশেষ সময়ে কাজ করেন তাদেরকে মৌসুমি বা প্রচ্ছন্ন বেকার বলা হয়।
বেকার সমস্যার কারণ : বাংলাদেশের বেকার সমস্যার জন্য কোনো একক কারণ দায়ী নয়। কারণগুলো নিচে তুলে ধরা হলো :
ক. ঔপনিবেশিক শোষণ : বাংলাদেশে বিদ্যমান বেকার সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে। বাংলাদেশের বেকারত্বের অভিশাপ সৃষ্টির অন্যতম কারণ দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ ও বঞ্চনা। ইংরেজি ঔপনিবেশিক শক্তি এ দেশের প্রচলিত শিল্পকে ধ্বংস করে নিজেদের পণ্যের বাজারে পরিণত করেছিল। পাকিস্তানি শাসনের প্রভাবেও এ দেশের অর্থনীতির ভিত্তি ধ্বংস হয়েছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং যুদ্ধপরবর্তী সময়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শোষকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে নব্য স্বাধীন দেশকে দাবিয়ে রাখতে। তাদের শোষণ ও বঞ্চনা বাংলাদেশে বেকারত্বের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে।
খ. ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা : আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল সেই ইংরেজ আমলে। ইংরেজরা প্রশাসনিক ও তাদের ব্যবসার হিসাব সংরক্ষণের কাজের জন্য এ দেশীয় কেরানি শ্রেণি গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে একটি শিক্ষাব্যবস্থা এই জাতির ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। ইংরেজরা চলে যাওয়ার এত বছর পরও শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিক যুগের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে।
গ. জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে কর্মসংস্থান হচ্ছে না : প্রতিবছর যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সে অনুপাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। কর্মসুযোগ হ্রাস ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির এ অসম অনুপাত বেকারত্বকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলছে।
ঘ. কুটিরশিল্পে ধস : ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের কুটিরশিল্পে ছিল ঐতিহ্যবাহী। এ দেশের কামার, কুমার, কাঁসারি, শাখারি, তাঁতি, বাঁশ, ও বেতজীবী মানুষেরা নীরবে নিভৃতে নিজ নিজ চিরাচরিত পেশায় নিয়োজিত ছিল। কিন্তু যন্ত্রসভ্যতা, শিল্পবিপ্লব এবং যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এ দেশের কুটিরশিল্প বিলুপ্তির পথে। ঐতিহ্যবাহী দেশীয় পণ্যের বদলে দিন দিন কল-কারখানায় তৈরি পণ্য চাহিদা বাড়ছে। ফলে কুটিরশিল্পের সাথে জড়িত পেশাজীবীরা কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছে।
ঙ. অপর্যাপ্ত শিল্পায়ন : প্রতিদিন কৃষিব্যবস্থা সংকুচিত হয়ে আসছে। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার সাথে কৃষিকাজে শ্রমিকের চাহিদা কমছে। কাজেই শুধু কৃষির ওপর নির্ভর না করে ব্যাপকভিত্তিক শিল্পায়ন হলে কেবল বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান সম্ভব। শিল্পোন্নত জাপানে বেকারত্বের হার ৫% এর নিচে, যুক্তরাষ্ট্রে ৭% ও যুক্তরাজ্যে ৯% মাত্র। আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান। এ দেশে মূলত শ্রমঘন ও কৃষিনির্ভর শিল্প গড়ে না ওঠায় বেকারত্ব প্রতিদিন তীব্র আকার ধারণ করছে।
চ. প্রাকৃতিক দুর্যোগ : বাংলাদেশের মানুষের নিত্যসঙ্গী নানা প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বন্যা, খরা, নদীভাঙন প্রভৃতি দুর্যোগ কৃষিকাজ ব্যাহত করে এবং গ্রামীণ জীবনে বেকারত্ব ডেকে আনে। বিশেষ করে নদীভাঙনের ফলে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ জমিজমা ও ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। জীবিকার অভাবে অনেকে ভিক্ষাবৃত্তি, দিনমজুরি প্রভৃতিতে লিপ্ত হতে হয়।
ছ. কায়িক শ্রমের অবমূল্যায়ন : আমাদের দেশে শারীরিক শ্রমকে অশিক্ষিত ও মূর্খদের কাজ বলে মনে করা হয়। ফলে লেখাপড়া করে অফিস-আদালতের বাইরে শারীরিক শ্রমমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করার কথা কেউ ভাবতেই পারে না। অনেকে শারীরিক কাজ করাকে অসম্মানজনক মনে করে, তারা কায়িক শ্রমের কাজের চেয়ে বেকার থাকতে পছন্দ করে। এমন ভুল মানসিকতাও বেকারত্ব বাড়ার অন্যতম কারণ।
জ. নষ্ট রাজনীতি : বেকারত্বের অন্যতম কারণ নষ্ট রাজনীতি। স্বৈরশাসন, গণতন্ত্রহীনতা, দুর্বল নেতৃত্বের প্রভাবে দেশে নষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। দলের কর্মী সমর্থক বাড়ানোর নাম করে যুবকদের কর্মবিমুখ, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী হিসেবে গড়ে তুলে তাদের কর্মোজ্জ্বল ভবিষ্যতের কবর রচনা করা হয়।
বেকার সমস্যা সমাধান : বেকারত্ব আমাদের সমাজের জন্য একটি অভিশাপ। এর ফলে অসংখ্য আর্থসামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। তাই এই সমস্যা সমাধানে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫ (ঘ) অনুচ্ছেদে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার তথা প্রত্যেক নাগরিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা একটি আদর্শ ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে অবশ্যই রাষ্ট্রকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। যে জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া জরুরি তা নিচে উল্লেখ করা হলো:
ক. কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা : উপনিবেশিক ধ্যান-ধারণা থেকে বের হয়ে দেশে যুগোপযোগী কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষা প্রসার ঘটালে প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরি হবে। এরা দেশে বিদেশে উৎপাদনশীল খাতে খুঁজে পাবে কাজের অফুরন্ত সুযোগ। স্বল্পমেয়াদিও দীর্ঘমেয়াদি কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলতে পারলে স্ব-কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র বিস্তৃত হবে।
খ. কৃষির সাথে বিকল্প কর্ম সৃষ্টি : কৃষিকাজে নিয়োজিত মৌসুমি ও প্রচ্ছন্ন বেকারদের জন্য কুটিরশিল্পভিত্তিক বিকল্প কাজ সৃষ্টি করতে হবে। দেশের ভেতরে ও বিদেশে কুটিরশিল্প পণ্যের বিশাল বাজার ও ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। কুটিরশিল্পে পুনর্জাগরণ ঘটানো গেলে বেকারত্ব লাঘবের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়েরও ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।
গ. ব্যাপক শিল্পায়ন : বাংলাদেশে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে সে অনুপাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে বেকারত্ব দিন দিন বাড়ছে। এদের কর্মসংস্থানের জন্য ব্যাপক শিল্পায়নের দিকে নজর দিতে হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে পারলে এবং শিল্পায়ন বৃদ্ধি পেলে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে দেশ রক্ষা পেতে পারে।
ঘ. দক্ষ জনশক্তি রফতানি : বিপুল জনসংখ্যাকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনশক্তিতে পরিণত করতে হবে। দেশের বাইরে দক্ষ জনশক্তির ব্যাপক চাহিদা আছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ২০১৩ সালের হিসাবে, বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় ৮৩ লাখ। এই হিসেবের বাইরেও অনেক বাংলাদেশি দেশের বাইরে কাজ করছে। প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা তারা দেশে পাঠাচ্ছে। পরিকল্পিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ কর্মী গড়ে তোলে এবং সরকারি উদ্যোগে জনশক্তি রফতানির বাজার সম্প্রসারণ করলে আমাদের দেশে বেকারত্ব কমবে।
ঙ. দক্ষ নেতৃত্ব : রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল, ধর্মঘট, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ অন্যান্য বাধার কারণে বাংলাদেশে বিদেশি উদ্যোক্তারা পুঁজি বিনিয়োগে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। দক্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।
চ. শূন্য পদ পূর্ণ করা : বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। মোট পদসংখ্যা প্রায় এর দ্বিগুণ। এ শূন্য পদগুলোতে নিয়োগ দান করা হলে অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। আমাদের শিক্ষিত যুব শ্রেণি কিছুতেই চাকরি ছাড়া অন্য কোনো পেশা বা বৃত্তিকে গ্রহণের মানসিকতা পোষণ করে না। তাদের কাজ সৃষ্টিতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
ছ. দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন : কায়িক শ্রমের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। কৃষি ও শিল্প খাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পরিমাণ বাড়লে যেটি আপনাআপনিই ঘটবে। কায়িক শ্রমের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনার ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে।
উপসংহার : বেকারত্ব বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা। বেকারত্বের যন্ত্রণা বেকার ছাড়া অন্য কেউ কোনো দিন অনুভব করতে পারবে না। আমাদের দেশের অনেক যুবক বেকারত্ব ঘোচাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। বেকার জীবনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে সাগর, মরুভূমির পথে পা বাড়িয়ে দেশের হাজার হাজার যুবক প্রাণ হারাচ্ছে। এরা দেশের সম্পদ তাদেরকে বাঁচাতে হবে। সকল বাধা দূর করে দেশকে বেকার সমস্যা মুক্ত করতে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, জনপ্রতিনিধি ও বিত্তশালীদের ব্যাপকভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।