ভূমিকা : সততাই শ্রেষ্ঠ নীতি। মানব চরিত্রের অন্যতম একটি মহৎ গুণ হলো সততা। এই গুণ অর্জনের চেষ্টা ও চর্চা একজন মানুষকে পৌঁছে দিতে পারে মর্যাদা ও গৌরবের শ্রেষ্ঠতম শিখরে। নিষ্ঠার সঙ্গে নিরলস অনুশীলনের মাধ্যমে ব্যক্তি তার নৈতিক উৎকর্ষতা বাড়িয়ে এই গুণ অর্জন করতে পারে। সততার গুণ না থাকলে কেউ আদর্শ মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। সততাই মানব চরিত্রের অলংকার এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
সততা কী : মানবচরিত্রে অনেক সদগুণের সমষ্টিই সততা। সত্যের অনুসারী মানুষের সৎ থাকার প্রবণতার মধ্য দিয়ে সততার প্রকাশ ঘটে। অন্যায়, অবৈধ কাজ না করে ন্যায় ও সত্যের পথে জীবন পরিচালনা করাই সততার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সৎ চিন্তা ও সৎ কাজের মধ্য দিয়েই সততার মহৎ গুণের বিকাশ ঘটে। যারা পৃথিবীকে সুন্দর করে গড়তে চায় সেই সব মানুষ সততার চর্চা করে সমাজে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে।
সততার সুফল : সততার সুফল শতদলের মতো শত ধারায় বিকশিত। জীবনকে সুন্দর, সফল ও সার্থক করে তুলতে হলে সততার বিকল্প নেই। সৎ গুণসম্পন্ন মানুষ কখনও অন্যায় কাজে লিপ্ত থাকতে পারে না। সততার অলংকার ছাড়া কোনো মানুষ চরিত্রবান ও মহৎ হতে পারে না। সততার আলোকরশ্মি দেশ সমাজে ছড়িয়ে পড়লে সমাজ থেকে অন্যায়ের কুৎসিত অন্ধকার দূর হয়। সৎ লোক সমাজে সবার বিশ্বাসভাজন হয়ে থাকেন। যে সমাজে এমন বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা যত বেশি সেই সমাজ তত সমৃদ্ধ। সমাজের নেতৃত্ব সততার গুণে গুণান্বিত লোকদের হাতে থাকলে মানুষের জান, মাল, মান, সম্পদ নিরাপদ থাকে। তাই মানুষ চায় তাদের নেতা সৎ, সাহসী ও যোগ্য হোক।
মানুষের নৈতিক উন্নতি এবং মুক্তির বাণী নিয়ে পৃথিবীতে যত ধর্ম এসেছে তার সবগুলোতেই সততা, সত্যবাদিতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ধর্মের মূল কথাই হলো সততা।
সততার প্রভাব : সত্য হলো আলো আর মিথ্যা অন্ধকার। সত্যের আলোর প্রভাবে মিথ্যা দূর হয়। মিথ্যার সাথে জড়িয়ে থাকা পাপও দুর্বল হয়ে পালানোর পথ খুঁজতে থাকে। সততার প্রভাব উপলব্ধি করার জন্য সত্যসাধক হতে হবে। কারণ এর জ্যোতির্ময়তা অজ্ঞ লোকদের চোখে ধরা পড়ে না। কারণ তারা চোখ থাকতেও অন্ধ। তাদেরকে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হয়। কিন্তু এর বিপরীতে একজন সৎ লোকের সততার আলো শুধু তাকে নয়, তার সংস্পর্শে আসা অন্যরাও উপকৃত হয়।
সৎ লোকের সততার প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে অসৎ-মন্দলোক ও জীবনের গতি বদলে যায়।
সত্যের অনুসারী ব্যক্তির চিন্তায়, বিশ্বাসে ও প্রকাশে যে অভিব্যক্তি সেই সততাই মানবজীবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় চারিত্রিক দিক। এটি দুটি মানবীয় গুণ যাদের মূল্যবোধে ছড়িয়ে আছে, তারা কেবল মানুষ-ই নয়, বলা যায় মহামানুষ। বিশ্বাসের দৃঢ়তায় তারা বলিষ্ঠ, জগতে তাদেরই জয়-জয়কার। মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, ‘আমার জীবনের অভিজ্ঞতায় উপলব্ধি করতে পেরেছি যে একমাত্র সততা ও ভালোবাসা দ্বারা পৃথিবীকে জয় করা যায়।’
মহৎ মানুষের জীবন সততার দৃষ্টান্ত : মহামানবগণ সত্যের অনুসরণে তাঁদের জীবনের মহান সাধনাকে সফল করেছেন। মহৎ ও বরণীয় মানুষ মাত্রই সততার মূর্ত প্রতীক। সত্যবাদিতার জন্য যেমন তাঁরা লক্ষ্য অর্জনে সাফল্যলাভ করেছেন, তেমনি সত্যের বলে বলীয়ান হয়ে তাঁরা প্রবল শত্রুকেও পরাজিত করে নিজেদের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করেছেন। সর্বকালের মহামানব, মহাপুরুষ, মানব মুক্তির অগ্রদূত হযরত মুহম্মদ (সা.) সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর সমস্ত জীবন নানা দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে কঠোর সাধনা মগ্ন ছিলেন। সত্যের সাধনার বলেই তিনি সবার কাছে আল-আমিন বা বিশ্বাসী উপাধিতে ভ‚ষিত হন। সত্যের জন্য ক্রুশবিদ্ধ হয়েছেন যিশুখ্রিস্ট। সত্যকে সমুন্নত রাখতে হেমলক বিষপানে জীবন দিতে হয়েছে জ্ঞানপ্রেমিক দার্শনিক সক্রেটিসকে। এমনি করে সত্যের সাধনায় মহাপুরুষগণ জীবনকে যেভাবে গৌরবান্বিত করে গেছেন তেমনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন সততার মহান আদর্শ।
বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে সততার মূল্যায়ন : সততা বাস্তব জীবনের একটি মহত্তর দিক হলেও বাস্তব জীবনে বিশেষত দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তা যথার্থ মর্যাদা লাভ করতে পারছে না। সততা পথ হতে বিচ্যুত হয়েছে। ফলে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিকেই তারা প্রাধান্য দিয়ে নানা রকমের অত্যাচার, অনাচার ও দুর্নীতি করে চলেছে। অসততার প্রতি মানুষের তেমন প্রতিবাদ বা বিরূপতা দেখা যাচ্ছে না। ফলে ঘরে-বাইরে সর্বত্রই আজ মনুষ্যত্বের দীনতার চিত্র। আমাদের যুবসমাজ প্রতিনিয়ত অবক্ষয়ের দিকে অগ্রসরমান। একদিকে রাজনৈতিক দ্ব›দ্ব-কলহ, অন্য দিকে অর্থনৈতিক দুর্দশা, শিক্ষাজগতে নৈরাজ্য, সমাজসেবার নামে নিজের স্বার্থ হাসিল এবং স্বেচ্ছাচারিতা যুবসমাজকে বিপথগামী করছে। সমাজে সমাজবিরোধীর যে সম্মান, যে প্রতিপত্তি, সেখানে একজন জ্ঞান, সৎ মানুষের মূল্য তুচ্ছ। সততা সেখানে লাঞ্ছিত, অসহায়। বিবেক সেখানে বিবর্জিত। আজ তাই মানবিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধও গৌণ হয়ে উঠেছে। বস্তুত সমাজের সর্বস্তরে আজ যে সততা, সত্যবাদিতা ও মূল্যবোধের অভাব, তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া যুবকদের মাঝে প্রতিনিয়ত বিস্তৃত হচ্ছে।
আমাদের কর্তব্য : জীবনকে অবশ্যই সততার মাধুর্যে মণ্ডিত করতে হবে। অন্যায়ের মাধ্যমে বা অবৈধ উপায়ে কেউ যতই বিত্তশালী হোক না কেন তা যে পাপ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অসত্যের পরাজয় আসবেই ও ন্যায়ের পথ চির উজ্জ্বল থাকবেই। সৎ ব্যক্তি নৈতিক শক্তির বলে বলীয়ান। পরোপকারই তার জীবনের ব্রত। কখনো সে অন্যের ক্ষতির চিন্তা করেন না। মানুষের মনুষ্যত্ব বিকশিত হয় সততার গুণে। যে সমাজে সত্য ও সততার মূল্যায়ন নেই, সেই সমাজে মানুষ ও পশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সেই সমাজ ক্রমে নানা পাপাচারে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকে। সেজন্য সততা ও সত্যবাদিতার অনুশীলন করতে হবে এবং জীবনে তার প্রতিফলন ঘটিয়ে যথার্থ মনুষ্যত্বের অধিকারী হতে হবে। বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে সমাজে আজ সৎ মানুষের প্রয়োজন খুব প্রকট। তাই আমাদের সকলের প্রয়োজন সত্যের সাধনা।
উপসংহার : সততা সুন্দর, সততা মহান। আমাদের চরিত্রকে মহিমান্বিত করার জন্য, জীবনকে সফলতায় ভরে দেওয়ার জন্য সততার চর্চা অপরিহার্য। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের সততার পরিচয় দিতে ছোটবেলা থেকেই সৎ থাকার অভ্যাস গঠন করতে হবে। সততার অনুশীলন করতে হবে।