ভূমিকা : স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা আছে ছাত্রসমাজের গৌবরগাথা। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতাব্দী সময়ের পথপরিক্রমায় সামগ্রিক আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে যে উত্তরণের সৃষ্টি হয়েছে, তার নেপথ্যেও আছে একদল দেশপ্রেমিক তরুণ তাজাপ্রাণ ছাত্রসমাজের উজ্জ্বল ভূমিকা। দেশকে আরো এগিয়ে নিতে ছাত্রসমাজকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন অব্যাহত রাখতে হবে। ষাটের দশকে যে ছাত্র আন্দোলন ছিল, তা স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে স্বাধিকার আন্দোলন। আজকের আন্দোলন দেশ গড়ার। এই দেশ গড়ার আন্দোলনে ছাত্রসমাজ কীভাবে ভূমিকা পালন করবে? এই প্রশ্নের উত্তরে নানামুনির নানা মত থাকলেও আন্দোলন সংগ্রাম, রাজনীতির বাইরে থেকেও যে ছাত্রসমাজের সমাজকল্যাণে ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে- এ ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই।
পড়ালেখাই একমাত্র সাধনা : সংস্কৃত একটি শ্লোক আছে, ‘ছাত্রনং অধ্যয়নং তপ’ অর্থাৎ ছাত্রদের একমাত্র সাধনা অধ্যয়ন করা। ছাত্ররা এই কাজটি সঠিকভাবে করলে দেশ ও সমাজে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। যার যা দায়িত্ব তা সঠিকভাবে পালন করার নামই দেশপ্রেম। শিক্ষার আলো ছাত্রদের হাতে থাকলেই সে আলোকিত সমাজ গঠনে অংশ নিতে পারে।
নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্রসমাজ : নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে না পারলে আমরা বেশিদূর যেতে পারব না। তাদের নিজেদের পড়ালেখার ফাঁকে কিংবা বিভিন্ন ছুটির দিনে ছাত্ররা পরিকল্পিতভাবে নিরক্ষরতা দূর করতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। যার যার বাড়ি বা বাসার কাজের ছেলে-মেয়ে, গ্রাম ও শহরের সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের একজন সদস্যকে সাক্ষর করতে যদি একজন করে ছাত্র দায়িত্ব নেয়, তাহলে সমাজে নিরক্ষর ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মানবসেবা : মানবসেবা পরম ধর্ম। একজন ছাত্র লেখাপড়ার উদ্দেশ্য ছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায় মানবিকবোধকে জাগ্রত করতে। লেখাপড়া শেষ করে সে দেশ ও দেশের মানুষের সেবা করবে - এই শিক্ষাই তাকে দেওয়া হয়। পুঁথিগত বিদ্যার সাথে মানবসেবার বিষয়টি তাকে হাতে-কলমে শিক্ষা দিতে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন সংঘ আছে। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়সহ দেশ ও জাতির বিভিন্ন সংকটে এইসব সংগঠনের ব্যানারে ছাত্রসমাজ সমাজসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
বৃক্ষরোপণ অভিযান : মানবসভ্যতার জন্য গাছের গুরুত্ব অপরিসীম। এই গুরুত্ব অনুবাধন করেই প্রতিবছর সরকারি উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ পালিত হয়। এই অভিযান সার্থক করতে ছাত্রসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা বাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি রাস্তাঘাটের পাশে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে গাছ লাগিয়ে সমাজ উন্নয়ন ও দেশ গড়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
চিকিৎসাসেবা : শুধু বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে নয় অন্যান্য সময়ও ছাত্ররা চিকিৎসাসেবায় ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা যে এলাকায় বসবাস করে সেই এলাকার সামর্থ্যবান লোকদের ব্লাড গ্রুপিং করে তার তালিকা সংরক্ষণ করে জরুরি প্রয়োজনে রক্ত সংগ্রহ পারে। অসহায় রোগীদের হাসপাতালে নিতে সহযোগিতা করতে পারে। ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করা, গণসচেতনতা সৃষ্টি এবং কলেরা ও অন্যান্য রোগে খাবার স্যালাইন ও সরবরাহ সচেতনতা সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করতে পারে।
মাদকাসক্তি রোধে ভূমিকা : মাদকাসক্তি বাংলাদেশে অন্যতম একটি জাতীয় সমস্যার নাম। মাদকের বিস্তার ও অপব্যবহার গোটা যুবসমাজের ওপর আঘাত করেছে। সাধারণত উচ্ছল তরুণ সমাজ ও কোমলমতি কিশোররা মাদকের নেশার পথ ধরে চলে ধ্বংসের পথে। নেশার ফাঁদে পড়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে। মাদকের প্রতি ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়ছে নতুন প্রজন্ম। এজন্য অনেকাংশে দায়ী মাদকের কুফল সম্পর্কে ছাত্র ও তরুণদের অজ্ঞতা, উদাসীনতা, অসচেতনতা। ছাত্রসমাজ এই অজ্ঞতা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
দরিদ্র ছাত্রদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ : সামর্থ্যবান ছাত্ররা মিলে তাদের পুরাতন বই সংগ্রহ করে দরিদ্র ছাত্রদের মাঝে বিতরণ করতে পারে। তাদের পুরোনো জামা-কাপড় ফেলে না দিয়ে দরিদ্র বন্ধুদের উপহার দিতে পারে। বিন্দু হতেই সিন্ধু হয়, সবাই দশ/পাঁচ টাকা করে দিয়ে ফান্ড গঠন করে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাঝে খাতা-কলম ও অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করতে পারে।
পল্লি উন্নয়নে ভূমিকা : আমাদের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বাস কারে। কিন্তু অশিক্ষা, অবহেলা আর কুসংস্কারের কারণে গ্রামের মানুষ অনেক দিক থেকে পিছিয়ে। ছাত্রসমাজ পল্লি উন্নয়নে হাতের আলোর মশাল নিয়ে এগিয়ে এলে প্রতিটি গ্রামে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে। তারা সরকারের একটি বাড়ি একটি খামার, খাল কাটা, বায়োগ্যাস প্রকল্প, বিভিন্ন টিকা দান কর্মসূচি পালনে সহযোগিতা করতে পারে। বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রকল্পকে এগিয়ে নিতে তথ্যপ্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহারেও সহযোগিতা করতে পারে। পল্লির অশিক্ষিত অর্ধ-শিক্ষিত কৃষকদের মাঝে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষির ধারণা সৃষ্টিতেও ছাত্রসমাজ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। ‘একতাই বল’ মন্ত্রে তাদের উদ্বুদ্ধ করে সমবায়ের ভিত্তিতে উন্নত জীবন গড়ার কাজেও ছাত্রসমাজ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে।
অন্যায়ের প্রতিবাদ : ছাত্রসমাজ চিরপ্রতিবাদী। তারা অন্যায়-অবিচার সহ্য করে না। আমরা যদি আমাদের ইতিহাসের দিকে তাকাই দেখতে পাব, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধসহ ইতিহাসের প্রতিটি পর্বেই লেখা আছে এ দেশের ছাত্রসমাজের রক্তরাঙা ইতিহাস। সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচার দূর করতে ন্যায়ের পক্ষে আজও ছাত্রসমাজ সোচ্চার হলে কোনো শক্তিই তাদের রুখতে পারে না। সমাজ থেকে অন্যায় অবিচার দূর করতে তারা সোচ্চার ভ‚মিকা পালন করতে পারে। বাল্যবিবাহ, অনিয়ম, দুর্নীতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে পারে।
উপসংহার : ছাত্রসমাজকে সব সময় মনে রাখতে হবে, ‘বিশ্ব গড়তে হলে সবার আগে নিজেকে গড়তে হবে।’ তাদেরকে সবার আগে নিজেকে গড়ার দিকে মনোযোগী হতে হবে। সমাজ উন্নয়নে তারা যে ভূমিকা পালন করবে তা তাদের সহ-শিক্ষামূলক কাজ বলে গণ্য হবে। দেশের ভবিষ্যৎ যোগ্য ও দক্ষ কর্ণধার হিসেবে নিজেকে গড়তে এ ধরনের কাজের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু তাই বলে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার বাইরে গিয়ে মূল কাজের ক্ষতি করে নয়। তাদেরকে বুঝতে হবে, শিক্ষক ও অভিভাবকরা চালিত হন বিবেক দিয়ে, কিন্তু তরুণদের বিবেকের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই আবেগ বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাই তাদেরকে অবশ্যই শিক্ষক ও অভিভাবকদের পরামর্শ মেনেই সমাজকল্যাণে অবদান রাখতে হবে।
[সি. বো. ১৫, ব. বো. ১১, দি. বো. ১১]