বাংলা কথাসাহিত্যের শক্তিমান লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত নাটক 'উজানে মৃত্যু (১৯৬৬)। বাংলা নাট্যসাহিত্যে এক বিরল ও নিঃসঙ্গ সৃষ্টি। অ্যাবসার্ডধর্মী নাটক ‘বহিপীর’-এর মাধ্যমে যে নাট্যযাত্রার সূচনা তরঙ্গভঙ্গ’ ও ‘সুড়ঙ্গ’-এর মােহনা পেরিয়ে উজানে মৃত্যু’ নাটকে এসে তা পূর্ণতা পেয়েছে।
বিশ শতকের মানুষের জীবনে কোনাে গল্প নেই। ঈশ্বরহীন পৃথিবীতে সে নিয়ত একা। গভীর অনিকেতবােধ, অপার শূন্যতা চেতনাকে বহন করেই সে প্রাণ ধারণ করে আছে, ভােগ করে চলেছে তারই পুনরাবৃত্ত জীবনের গ্লানি, দুঃখবােধ ও বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা।
উজানে মৃত্যু এই বিপন্ন মানব- চৈতন্যের কথাবস্তু। উজানে মৃত্যু গল্পহীনের গল্প, ঘটনাহীনদের বিচূর্ণিত ঘটনাপুঞ্জের সমাহার, নৌকাবাহক, কালাে ও সাদা পােশাক পরিহিতের দুর্বার জীবনানুভূতির প্রতীতি।
নৌকাবাহকের এক সময় স্ত্রী-পুত্র, উর্বর জমি সবই ছিল। কিছুই তার জন্য অপেক্ষা করে নেই। এখন সে সর্বরিক্ত, কালের করাল গ্রাসে পতিত, এক পরাজিত ও বেদনাময় সত্তা। জীবনের যন্ত্রণা হতে মুক্তি পেয়ে শান্তি ও স্বস্তির জগতে পৌছতে তার নৌকা বাওয়া, স্বনির্বাচিত মৃত্যুকে আহ্বান করার জন্যই তার দাঁড়টানা।
বস্তুত প্রতিষ্ঠিত ও পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থা যখন মানুষকে বিপর্যস্ত, ক্রমশ নিরস্তিত্ব ও নিমজ্জিত করে তখন বহমান সমাজ-চৈতন্যের সাথে অভিন্ন হয়ে অস্তিত্ব ঘােষণা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় অস্তিত্বকামী মানুষ হয়ে পড়ে নিঃসঙ্গ।
নৌকা বাহকের পরিণতির জন্যেও কেউ দায়ী নয়। নিজের সত্তার মধ্যেই লালন করেছে এক বৈনাশিক শক্তি। অন্তরের শুদ্ধ চৈতন্য দিয়ে সে জেনেছে যে, তাকে কোথাও না কোথাও যেতে হবে। জীবনের চরম সত্যকে উপলব্ধি করার পরও মানুষ সংগ্রামী হয়ে ওঠে এ নাটকের মঞ্চসজ্জায় অ্যাবসার্ড পদ্ধতি বিন্যস্ত। তাই এ নাটকের মঞ্চ বাইরে নয়, দর্শক-পাঠকের অন্তরে, তাদের মেধা ও অনুভূতিলােকেই এর অবস্থান।
মঞ্চে আছে অন্ধকার, শূন্যতা ও একটি মানুষের হাঁপানির আওয়াজ। হাঁপানির আওয়াজ পৌনঃপুনিক ব্যবহারের ফলে লাভ করেছে প্রতীকী ব্যঞ্জনা। এ আওয়াজ কেবল নৌকাবাহকের বেদনা প্রকাশক ধ্বনি নয়, সভ্যতার, ধনবাদী সমাজ ব্যবস্থায় যূপবিদ্ধ মানুষের অবরুদ্ধ যন্ত্রণারও তা অভিব্যক্তি। গ্রামীণ পরিবেশে নদী ও নৌকার অনুষঙ্গে নাটকটি রচিত হলেও বিংশ শতাব্দীর বাস্তব পরিস্থিতিকে ধারণ করা হয়েছে।
Be Connected with us: Facebook Page Or Join to Our Facebook Goup