বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তার রচিত ‘খােয়াবনামা’ (১৯৯৬) বাস্তবনিষ্ঠ উপন্যাস।
গ্রাম বাংলার নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের জীবনালেখ্যসহ ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, আসামের ভূমিকম্প, তেভাগা আন্দোলন, ১৯৪৩-এর মন্বন্তর, পাকিস্তান আন্দোলন ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ইত্যাদি ঐতিহাসিক উপাদান এ উপন্যাসে নিপুণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রধানত মধ্যবিত্তের জীবন নিয়ে লিখিত খােয়াবনামা উপন্যাসটি।
যাদের জীবন নিয়ে রচিত তাদের অধিকাংশই সমাজের নিম্নতম শ্রেণির । অভাবের তীব্রতায়, জীবন সংগ্রামের তীব্রতায় এরা যেন ভাস্কর্যের মতােই দৃঢ়প্রত্যয়ী। পাকিস্তান আন্দোলন ও দেশভাগের পটভূমিতে রচিত এ উপন্যাসে রূপায়িত হয়েছে ছয় দফার আন্দোলন এবং শহুরে শ্রমজীবী ও গ্রামীণ কৃষকের বাঁচার লড়াই।
নিম্নবর্গের শ্রেণিভিত্তিক লড়াই কিভাবে পরাস্ত হয় উচ্চবর্গের নিকট তাও উন্মােচিত হয়েছে এ উপন্যাসে। বাঙালি মুসলিম কৃষকের স্বপ্ন অচিরেই ভেঙে গুড়িয়ে গিয়েছিল সেই স্বপ্নভঙ্গের চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে খােয়াবনামা উপন্যাসে।
খােয়াবনামা উপন্যাসের অনেক স্থান নামহীন। তমিজের বাপও নামহীন, সে শুধু তমিজের বাপ। সে জীবনভর স্বপ্ন দেখে। তার স্বপ্ন দেখা ঘুমিয়ে নয়, জেগেই এবং ১৯৪০ এর দশকে উত্তাল বাংলা তথা ভারতের বর্তুল রাজনীতির সঙ্গে কিন্তু তার স্বপ্ন অতীব সমরেখ। আকাল, আধিয়ার, তেভাগা, মুসলিম লীগ-কৃষক প্রজা পার্টি, পাকিস্তান প্রস্তাব, '৪৬ এর নির্বাচন, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় আচ্ছন্ন দেশ, ইতিহাসের ভিসুভিয়াস তখন তার জ্বালামুখ খুলে দিয়েছে, আর তমিজের বাপ তখন অভিসারে বেরিয়েছে চেরাগ আলীর খোজে, যে তাকে এসব স্বপ্নময় বাস্তবের অথবা বাস্তবে স্বপ্নের যথার্থ তাৎপর্য বলে দেবে।
রাতভর পদচারণা করতে করতে সে হঠাৎ আবিষ্কার করে, এতদিন ধরে দেখে আসা কালাহার বিলের ধারের পাকুড় গাছটা নেই, এবং গাছটির অনস্তিত্ব সম্পর্কে গ্রামের কেউই অবহিত নয়, এমনকি বিষয়টি তাদের কাছে কৌতুহলেরও নয়।...এতদিনকার শাশ্বত ইতিহাসকে ছিড়ে, আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষকে ছিড়ে রচিত হতে চলেছে দেশত্যাগের মতাে এক ক্রান্তিকাল, আভাস রচিত হচ্ছে তার কলকাতার দাঙ্গায়, শহরে গঞ্জে ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ ধ্বনিতে, জিন্নাহ, শরৎ বসু, ফজলুল হক, সােহরাওয়ার্দীর বক্তৃতায়, এখন এই পাকুড় গাছটি অর্থাৎ ঐতিহ্যটি, ঐতিহ্যের শিকড়টি আর থাকে কি করে!
এইভাবে একে একে খুলে পড়তে থাকে ইতিহাসের কুটিল মুখােশ, গলি আর রাজপথ অসংলগ্ন হয়ে পড়ে ইতিহাসের পালের দাপটে, আর বিদায় নিতে থাকে স্বপ্নের, আর অবিনাশী সভ্যতার প্রতীক পাকুড় গাছের অবহিতি সম্পর্কেও সচেতনতা থাকে না মানুষের, কেননা, ‘হেথা হতে যাও পুরাতন, হেথায় নতুন খেলা আরম্ভ হয়েছে। তমিজের বাপ তবু পাকুড় গাছহীন পাকুড় গাছের নিবিড় ছায়ায় বসে
খােয়াবনামা উপন্যাসের চালচিত্রে ধরা পড়েছে বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে। উপন্যাসটি তাই হয়ে উঠেছে সমগ্র বাঙালি জাতিরই স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, নতুন স্বপ্নে জাগ্রত হওয়ার খােয়াবনামা। যারা সর্বহারা বা প্রােলেতারিয়াত বলে পরিচিত, তাদের অশ্রু, স্বেদ, রক্ত, স্থৈর্য আর আকাঙ্ক্ষার, দ্রোহ, চাতুর্য আর সংঘাতের বাহ্যিক আবরণের অতিসূক্ষ শবব্যবচ্ছেদ রয়েছে এ উপন্যাসে।
চল্লিশের দশকের রাজনীতি হিন্দু-মুসলামান দুই সম্প্রদায়ের ধর্মীয়, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থানের উপর যে নানামাত্রিক, প্রবল বিচিত্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল সে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে খােয়াবনামা উপন্যাসে। শরাফতের বাড়ি হুমায়ূনের অসুস্থতার সময় তাকে দেখতে এসেছেন শহরের বড় ডাক্তার আর তার কম্পাউন্ডার। হিন্দু ডাক্তার শিশির সেন রােগী দেখে নির্দ্বিধায় পায়েস খান মুসলমানের বাড়িতে। কিন্তু খায় না ব্রাহ্মণ কম্পাউন্ডার। শুধু তাই নয়, শিশির ডাক্তারের বাড়িতেও সে খায় না। কারণটি জানা যাক কম্পাউন্ডার প্রশান্তর উচ্চারণে : আমরা গরিব বামুন, আমাদের অর্থবল নেই, প্রতিপত্তি নেই, জাতটা গেলে আমাদের আর থাকে কী? এখানে গরিব মানুষের সামাজিক কুসংস্কার ও রক্ষণশীলতাকে অনুসরণ করার বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে।
উপন্যাসটির চরিত্র-পাত্ররা তাদের অপরিমেয়, অকল্পিত দুরবস্থার মধ্যেও সমস্ত রকম আর্থিক, সামাজিক, কখনাে- বা আত্মিক মুক্তির অভীপ্সায় চালিত হয়েছে। এক সামন্ত যুগের নিগড়ে বাধা রয়েছে যে সমাজ; আবহমান ধরে যখন সমাজের প্রান্তিক মানুষেরা শােষিত-বঞ্চিত, রিক্ত, নিঃস্ব তখন তমিজ, বৈকুণ্ঠ, কুলসুম, হুরমতুল্লা, কেরামতের মতাে অসংখ্য মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে অযুত ভাবনা উপন্যাসটিকে ভরিয়ে তুলেছে উদ্বেগে।
‘খােয়াবনামা’ উপন্যাসটি বয়ন করা হয়েছে ভালােবাসার সামাজিক বন্ধন দিয়ে। হাফিজ বলেছেন, মজহাব এ ইশক’-তার রচনার প্রেরণার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে প্রেম, ইলিয়াসেরও তেমনি গভীর প্রেম মানুষের প্রতি, মানবতার প্রতি। তাই যা তাকে বিদ্ধ করে মনুষ্যেতর ভাবতে শেখায় তাকে তিনি দগ্ধ করেন ব্যঙ্গে, জ্বিপে, কটাক্ষে আর কষাঘাতে। আবার প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের মধ্যেও তিনি দেখান উদার বাসন্তী হওয়া; অর্থাৎ তার তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই রয়েছে ভালাে-মন্দের দ্বন্দ্ব।
উপন্যাসটি সুবৃহৎ হওয়া সত্ত্বেও এক আশ্চর্য সংহতি। Harmony রয়েছে এর প্রধান প্রধান চরিত্রের মধ্যে। বিশেষ করে তমিজের বাপের স্বভাবের বৈচিত্র্য নিয়েও তার জীবনযাপন সত্যিকারের মুক্তপুরুষের Harmony নিয়ে। দস্তয়ভস্কির যেমন আলিয়মা শেক্সপিয়রের প্রসপেরাের হারমনি তাই তমিজের বাপের পাকুড় গাছের অন্বেষণে চোরাবালিতে তলিয়ে যাওয়া, এরূপ আকস্মিক, অসংগঠিত, অপূর্বকল্পিত এবং ব্যঞ্জনাময় মৃত্যু মর্যাদা দিয়েছে সেই Harmony-কেই।
উপন্যাসটিতে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে রয়েছে প্রতিবাদ, রয়েছে দেশভাগের প্রতি ঔপন্যাসিকের শৈল্পিক অসমর্থন। তবে তা কখনাে তীব্রভাবে উচ্চারিত নয়। উপন্যাসে একটি দুটি গ্রামের গল্পের মধ্য দিয়ে প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে ‘গ্রাম ও শহর, জনপদ, ঢাকা, কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই, লাহাের সমগ্র ভারতবর্ষ '৪৭ পূর্ববর্তী ভারতবর্ষ। তাই এ এক যথার্থ বিশ্বমুখ দর্পণ।
Be Connected with us: Facebook Page Or Join to Our Facebook Goup