সৈয়দ মুজতবা আলী রম্য রচনাকার হিসেবে সমধিক প্রসিদ্ধ। দেশে-বিদেশে’ (১৯৪৯) ভ্রমণ কাহিনিটি লেখকের প্রথম গ্রন্থ। এ গ্রন্থের মাধ্যমেই তিনি বাংলা সাহিত্যের আসরে স্থায়ী আসনের দাবিদার। হাওড়া থেকে কাবুল গমন এবং কাবুলে কিছুদিন অবস্থান করায় বিচিত্র অভিজ্ঞতায় এ ভ্রমণ কাহিনির জমিন ভরে উঠেছে।
পাথর পাহাড় বরফের রুক্ষ কর্কশ দেশেও লেখক পেয়েছিলেন প্রাণের পরশ। দুরধিগম্য প্রতিধ্বনিতে দেশটি তার ভালাে লেগেছিল। শৈত্য, অনাহার-অর্ধাহার, উৎকণ্ঠায় কন্টকিত প্রতিধ্বনিতে মৃত্যু ঘণ্টার সংকেত এমনি সংকটময় মুহূর্তেও জীবনের রসরূপ দর্শনে তিনি পারঙ্গম। তাই তিনি যথার্থ জীবন রসিক ।
প্রথমে তালতলার নেটিভ ফিরিঙ্গীকে দেখে জ্ব-কুঞ্চিত হয়। অতঃপর তার ফিয়াসে প্রদত্ত ডিনার আর কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রিট থেকে ক্রীত লেখকের ভােজ্য সামগ্রীর রূপরসগন্ধের অপূর্ব সাদৃশ্যে আমাদের কৌতুকবােধ উচ্ছ্বসিত হয়। অল্প সময়ের মধ্যে ফিরিঙ্গী কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায়। শুধু তার খাবারের চাঙারিতে লেখকের উদ্দেশ্যে লাগানাে চিরকুট ‘গুডলাক ফর দি লং জার্নি ফিরিঙ্গী চরিত্রকে রসসিক্ত করে তােলে।
বাসে কাবুলে পৌছানাের পূর্বেই সূর্য অস্ত গেল। বাসটির একটিমাত্র অকেজো হেডলাইট। ড্রাইভার রাকতানা। পথচারীদের হিতার্থে একটি লণ্ঠন জোগাড় করে মাডগার্ডের উপর রাখা হল। হারিকেনের ক্ষীণ আলােয় গাড়ি চালনায় অসুবিধা হচ্ছে কিনা প্রশ্ন করায় সর্দারজী বলছেন, হচ্ছে বই কি, আলােটা চোখ ধাধিয়ে দেয়। ওটা না থাকলে গাজি জোরে চালাতে পারতুম। পথের প্রাণঘাতী বাঁক অতিক্রম করার প্রসঙ্গে লেখক বলেন, সর্দারজী চোখ বন্ধ করেই চালায়।
লেখকের সহযাত্রী কাবুল বেতারের সহযাত্রী বর্ণিত ঘটনাটি ফেরী আসামির শূন্যস্থান পূরণের জন্য ধৃত হতভাগ্য গ্রামবাসীকে সারা জীবন পঁয়তাল্লিশ নাম্বার হয়েই থাকতে হয়। ষােল বছর ওই মন্ত্র জপ করে তার বিশ্বাস হয়ে গিয়েছে তার নাম ধাম নেই, সাকিন ঠিকানা নেই, তার পাপ নেই, পুণ্য নেই, জেলের ভেতরের বন্ধন নেই, বাইরের মুক্তি নেই তার সম্পূর্ণ অস্তিত্ব তার সর্বৈব সত্তা ঐ এক মন্ত্রে, আমি পঁয়তাল্লিশ নম্বরের। বিয়ে বাড়িতে রাতে গানের আসরে বৃদ্ধ যখন সুর ধরেছে তখন মনে হয়েছে যেন বয়সের নিগড়ে বাধা মনের যৌবন দেহের ক্ষয়িষ্ণু শেষ সীমান্ত থেকে ফিরে আসতে চায়। সে কী আকুল আর্তি, সে কী ব্যাকুল বেদনা মূর্ত হয়ে উঠেছে নিপুণ শিল্পীর রসবােধে। যযাতির মতাে সে ফিরে চাইছে তার অবরুদ্ধ যৌবন শত সহস্র বছরের জন্য নয়, মাত্র একটি রাতের জন্য। কী অপূর্ব রসবােধ শিল্পীর।
সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখায় একই সাথে এসেছে হাস্যকৌতুক, গভীর বেদনা। সবকিছু ছাপিয়ে পূর্ণাবয়ব পেয়েছে তার সহানুভূতি সিক্ত মানুষ। এর মুখ্য মূল্য হচ্ছে যে এতে কতকগুলাে মানুষের মনের পর্দা খুলে আসল মানুষগুলােকে চিরকালের জন্য ধরে দেওয়া হয়েছে। কাবুলে তার দুর্দশার সূচনা-
বাচ্চা গাজী রূপে বাদশা হয়ে আমানউল্লাকে কাফের’ ঘােষণা করে তার কর্মের সহায়ক বিবেচনা করে দেশি-বিদেশি শিক্ষক অধ্যাপকদের চাকুরিচ্যুত করে স্কুল কলেজে তালা ঝুলিয়ে দিলেন। এ দুঃসময়ে একজন ভারতীয় মৌলানা জিয়াউদ্দিন অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী নিয়ে লেখকের সাথে একই আশ্রয়তলে আসেন। দুর্দিনে মৃত্যুর মুখােমুখি দুই বন্ধুর প্রবাসের নির্মম স্মরণীয় দিনগুলাে আমাদের চিত্তবিনােদনের উৎস।
আপকালীন কাবুলে যখন এক পা মৃত্যুর দিকে, তখনাে তিনি বক্রদৃষ্টিতে পাঠানদের ওপর এক পলক চোখ বুলিয়ে যেন মিটিমিটিয়ে হাসছেন এবং কাবুলের বৃত্ত অতিক্রম করে দেখা দেন বাঙালি মুজতবা আলী। অরাজকতা শুধু মানুষ নয়, অন্যান্য প্রাণীরও প্রাণনাশক হয়েছে। বিশেষ করে আমানউল্লাহর হাতির করুণ অবস্থা লেখকের বর্ণনায় করুণতর রূপে দেখা দিয়েছে। এ প্রাণীটিও লেখকের চাকুরিদাতার আশ্রিত তীব্র শীতে জ্বালানি কাঠ ফুরালে রাত্রে গরম বানিয়ান, ফ্লানেলের শার্ট, পুলওভার, কোট, ওভার কোট ... উপরে দুখানা লেপ ও একখানা কার্পেট চাপিয়ে যমরাজকে ঠেকানাের চেষ্টা চলছে তখন মৌলানার কণ্ঠে তার প্রিয়তম গান-
কিংবা ডাকুর হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে যখন আপন ছাত্র উনিশ বছর বয়সী কর্নাইলে’র হাতে পড়লেন এবং সুসন্দেশ পেলেন তার ‘জেনরাইল’ হওয়ার সম্ভাবনা অতি নজদিক, মুআল্লিম সাহেবের তখনকার প্রতিক্রিয়া... আমি অত্যন্ত গর্ব করলুম, ধন্য আমার মাস্টারি, ধন্য আমার শিষ্য, ধন্য এ বিপ্লব, ধন্য এ উপবাসে। এসব বলে লেখক মনে করলেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা-
হালকা মেজাজে আড্ডার ঢঙে বলে গেলেও সৈয়দ মুজতবা আলীর জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, শাস্ত্রচর্চা আখ্যায়িকাপ্রধান ‘দেশে-বিদেশ ভ্রমণকাহিনিতে প্রত্যকক্ষাদৃষ্ট ঘটনা ও চরিত্রগুলাে আমাদের রসলােকে নিয়ে যায়।
Be Connected with us: Facebook Page Or Join to Our Facebook Goup