শওকত আলী রচিত ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন' (১৯৮৪) উপন্যাস সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের আওতায় লেখা সময়ের চালচিত্র, যার কাহিনিসূত্রে আছে একটি পরিবার ও সমষ্টিগত জীবনের দৃষ্টিভঙ্গির শৈল্পিক রূপায়ণ।
সেন রাজাদের রাজত্বকাল এবং তুর্কি আক্রমণের অব্যবহিত পূর্ব সময়ের পটভূমিতে এই কাহিনি রচিত। এই উপন্যাসের সময় ধরা হয়েছে রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকাল। অত্যাচারী সামন্তবর্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে অন্ত্যজ হিন্দু এবং বৌদ্ধের দল। ঔপন্যাসিকের বর্ণিত প্রদোষকালের মধ্যে আছে সামাজিক অস্থিরতা, সামন্তশ্রেণির শােষণপ্রবণতা, মুসলমানদের আগমন, বৌদ্ধভিক্ষুদের উপস্থিতি।
শ্যামাঙ্গ লীলাবতীর প্রেমে পড়েছে প্রথম দর্শনেই। সে মায়াবতীদের গৃহে আতিথ্য গ্রহণেও মুগ্ধ। লীলাবতী বিবাহিত। তার পিতার মৃত্যুর পর সে আরাে অসহায় ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে মানসিকভাবে। মামার উপদেশ আর শ্যামাঙ্গের প্রতি তার আকর্ষণ তাকে দ্বন্দ্বাকীর্ণ করে।
লক্ষ্মণসেনের সামন্ত প্রভুগণ উজবুট গ্রাম তছনছ করেছে। অগ্নিসংযােগ, ভাংচুর আর নির্যাতনের মাধ্যমে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে গ্রামবাসীকে গৃহছাড়া করে।
শ্যামাঙ্গ লীলাবতীর পরকীয়া প্রেমের আকর্ষণে তার সঙ্গী হয়েছে। গৃহহীনা লীলাবতী নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ধর্মত্যাগী হতে চেয়েছে কিন্তু শ্যামাঙ্গের শিল্পীসত্তা মানবপ্রেরণার উৎস হলেও ধর্মের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।
অথচ বিল্বগ্রামের রামায়ণ-কাহিনির চিত্রফলকে দেবতার মানবায়ন ঘটিয়েছে সে। যথােপযুক্ত যুক্তি দিয়ে গুরু বাসুদেবকে তার শিল্পকর্মে দেবতার মানবায়ন সম্পর্কে বােঝাতে চেষ্টা করেছিল যদিও বাসুদেব তা মেনে নিতে পারেনি। বাসুদেব মূল্যায়ন করেনি এবং স্বাধীন ও সৃজনী শিল্পীসত্তার প্রতি ঈর্ষাবােধ কাজ করেছে।
প্রদোষকালের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশও এজন্য দায়ী। স্বাধীনচেতা শিল্পী শ্যামাঙ্গ এজন্য গুরুকে ত্যাগ করতে দ্বিধা করেনি। সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক টানাপােড়েন বিশেষ করে আর্য ও অনার্য মানুষের মধ্যে পারস্পরিক অসাম্য এ উপন্যাসের বিষয়।
মানুষের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য ছিল চরমে। উপন্যাসে কোনাে একক ব্যক্তিকে নায়ক করা হয়নি। প্রাকৃতজন অর্থাৎ বাংলার গণমানুষ সমষ্টিগতভাবে এই উপন্যাসে নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
উপন্যাসটির ভাষা এর প্রধান সম্পদ। সঙ্গতি বিধানের লক্ষ্যে একাদশ শতাব্দীর অন্তিম কালের ভাষারূপ উপন্যাসে ব্যবহৃত হয়েছে। উপন্যাসে কথ্যভাষার ব্যবহার চরিত্রানুগ এবং সমাজবাস্তবতা প্রকাশের অনুকূল হয়েছে। ঔপন্যাসিকের সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রকাশ ঘটেছে ইতিহাসের আশ্রয়ে সমাজবাস্তবতার রূপায়ণে ।
Be Connected with us: Facebook Page Or Join to Our Facebook Goup