বাংলা নাট্য সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান নাট্যকার মুনীর চৌধুরী। তার প্রথম প্রকাশিত নাটক রক্তাক্ত প্রান্তর। ১৭৬১ সালে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের কাহিনি এই নাটকের পটভূমি।
ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলিম শক্তির আধিপত্যকে কেন্দ্র করে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর ভাষায় যতাে হিন্দু আর যতাে মুসলমান এই যুদ্ধে প্রাণ দেয় পাক ভারতের ইতিহাসে তেমন আর কোনােদিন হয়নি।
নাটকটি যুদ্ধকে আশ্রয় করে রচিত হলেও তিনি যুদ্ধকে প্রধানভাবে অবলম্বন করেন নি। নাটকে যুদ্ধের চেয়ে চরিত্রসমূহের ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ের বেদনাই বেশি ফুটে উঠেছে। ইতিহাসকে আশ্রয় করে রক্তাক্ত প্রান্তর নাটকটি রচিত হলেও এটি ঐতিহাসিক নাটক নয়।
রক্তাক্ত প্রান্তর নাটকে ইব্রাহিম কার্দি মুসলমান হয়েও নীতিগত কারণে মারাঠাদের পক্ষাবলম্বন করেন। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বন্দি এবং মৃত্যুবরণ করেন। অপরদিকে মুসলমানদের পক্ষে থাকা কার্দির স্ত্রী জোহরার ক্ষত-বিক্ষত হৃদয় থেকে রক্তক্ষরণই এ নাটকের বিষয়বস্তু।
নাটকের কাহিনিতে মারাঠা আর মুসলমানদের দ্বন্দ্ব দেখানাে হয়েছে। হিন্দু-মুসলিম শক্তির মধ্যে সংঘটিত ১৭৬১ সালে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধকে কেন্দ্র করে নাটকের কাহিনি আবর্তিত।
মারাঠাদের সেনাপতি ইব্রাহিম কার্দি মুসলমান হলেও দুর্দিনে পেশােয়া মারাঠা সেনাদলে তাকে চাকরি দিয়েছেন, সে কৃতজ্ঞতাবােধ থেকেই মারাঠাদের পক্ষে থাকা। কিন্তু তার প্রিয়তমা স্ত্রী সহধর্মিনী জোহরা স্বজাতিপ্রেমে উজ্জীবিত এক নারীযােদ্ধা। জোহরার প্রাণান্ত চেষ্টা মারাঠা শিবির থেকে তার স্বামীকে মুসলিম শিবিরে নিয়ে আসবেন কিন্তু তার সবচেষ্টা ব্যর্থ হয়। যুদ্ধে ইব্রাহিম কার্দি পরাজিত ও আহত অবস্থায় মুসলমানদের হাতে বন্দি হন। জোহরা স্বামীকে মুক্ত করার জন্য কারাগারে ছুটে যান। ইতােমধ্যে কার্দি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। দুর্গম পথ পেরিয়ে স্বামীর সান্নিধ্য প্রত্যাশী জোহরার বিদীর্ণ অন্তর হয়ে ওঠে মর্মন্তুদ রক্তাক্ত প্রান্তর।
রক্তাক্ত প্রান্তর নাটকের প্রধান চরিত্রগুলাে হলাে জোহরা, ইব্রাহিম কার্দি, নজীবদ্দৌলা, সুজাউদ্দোলা, আহমদ শাহ আবদালী। অপ্রধান চরিত্রগুলাের মধ্যে রয়েছে- হিরণবালা, আতাখা, জরিনা বেগম, রহিম শেখ, বশির খা ।
রক্তাক্ত প্রান্তর নাটকের প্রকৃতি বলা যায় ট্র্যাজেডি নাটক। প্রধান চরিত্রগুলাে অভিজাত শ্রেণির। নায়ক- নায়িকা বীর ও বীরাঙ্গনা । নিয়তি ও কর্মফল উভয় অন্তর্দ্বন্দ্বে প্রবাহিত। নায়কের করুণ মৃত্যুতে নায়িকার শূন্য হৃদয়ের হাহাকার এ নাটকটিকে বাংলা সাহিত্যে অন্যতম সার্থক ট্র্যাজেডি নাটকের মর্যাদা দান করেছে।
তিন অঙ্কবিশিষ্ট নাটকটির আটটি দৃশ্যের চারটি দৃশ্যই ট্র্যাজেডিতে মােহিত। অনেকে নাটকটিকে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি মনে করতে পারে। তাই নাট্যকার দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করেছেন— আমি নাটকের বশ, ইতিহাসের দাস নই। নাট্যকার ইতিহাসকে নাটকে ঐতিহ্য হিসাবে ব্যবহার করেছেন।
নাটকের ভাষায় রয়েছে কাব্যিক ঢং, তীর্যক বাকবিন্যাস, রসাত্মক কথােপকথন, আবেগ ও আন্তরিকতাপূর্ণ শব্দ ব্যবহার চরিত্রগুলাের নিজস্বতা নাটকটিকে সমৃদ্ধ করেছে।
হিরণবালা আর দিলীপ ছাড়া নাটকের সব চরিত্রই মুসলমান। সে কারণে আরবি, ফারসি শব্দের ব্যবহার বেশি। তাছাড়া হিন্দি শব্দের ব্যবহারও এ নাটকের ভাষাশৈলীকে করেছে সমৃদ্ধ। নাটকের ভাষা অলঙ্কৃত এবং সংলাপ উচ্ছ্বসিত ও পুষ্পিত। নাট্যকার সচেতনভাবেই এটা করেছেন এরকম আবেদন অনস্বীকার্য এবং শিল্পের বিচারে এই কৃত্রিমতা গ্রহণ করা যাবে।
এ নাটকের উৎস মহাশ্মশান কাব্য। সীমাবদ্ধতার ফলে আতা খাঁ ও দিলীপের চরিত্র পূর্ণতা পায় নি। নাটকের বিষয় প্রকরণ নাট্যকারের অনুকূলে ছিল না। নাট্যকার তৎকালীন জীবনাচার আমাদের সামনে উপস্থাপন করেন নি, বরঞ্চ নাটকের প্রধান চরিত্রসমূহের মধ্যে আধুনিকতা আরােপ করে যে সংকট তিনি সৃষ্টি করেছেন তাতে চরিত্ররা পূর্ণতা পেয়েছেন বটে কিন্তু আমাদের মনের দ্বন্দ্বকে প্রকট করেছে। সেদিক থেকে নাট্যকার নাটকের গতানুগতিক ধারা বদলে নতুনত্ব এনেছেন বলেই আমরা মনে করি।
নাটকের শৈল্পিকতা নির্ভর করে আকর্ষণীয় কাহিনি, যথার্থ চরিত্র-চিত্রণ, উপযুক্ত সংলাপ ও সুষ্ঠু পরিবেশের ওপর। সার্বিক বিবেচনায় বলা চলে মুনীর চৌধুরীর রক্তাক্ত প্রান্তর নাটকটি প্রশ্নাতীতভাবে শিল্পসফল এক রচনা।
Be Connected with us: Facebook Page Or Join to Our Facebook Goup