বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের (১৮২৪-৭৩) সগৌরব আবির্ভাব ঘটেছিল নাট্যরচনার সূত্র ধরে। বাংলা নাটকের দীনহীন অবস্থা প্রত্যক্ষ করে তিনি নাটক রচনায় আত্মনিয়ােগ করেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে তার বিস্ময়কর প্রতিভা বৈচিত্র্যমুখী হয়ে ওঠে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মহাকাব্যের ধারার সূত্রপাত ঘটে মাইকেলের হাত ধরে।
'সংস্কৃত মহাকাব্য রামায়ণের ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ কাহিনি অবলম্বন করে মধুসূদন দত্ত ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসের মধ্যে ‘মেঘনাদবধ
কাব্য রচনা যা বাংলা সাহিত্যের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য হিসেবে খ্যাত ।
মেঘনাদবধ কাব্যের বিরাট পটভূমির মধ্যে নানা ধরনের চরিত্র এবং নানা রসের সমাবেশ ঘটেছে ।
কবি কাব্যের প্রথম দিকে বীররসের কথা বললেও এই কাব্যে করুণরসই প্রধান ৷
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত সিপাহি বিপ্লবের স্বাধীনতামন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে রাবণকে নায়ক ও রামকে খলনায়ক করে মধুসূদন রচনা করে এই স্বাধীনতাভিলাষী কাব্য। নয় সর্গে সম্পূর্ণ ‘মেঘনাদবধ কাব্যে বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ থেকে মেঘনাদ- হত্যা, প্রমীলার চিতারােহণ পর্যন্ত মােট তিন দিন দুই রাতের ঘটনা বর্ণিত।
কবি মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট' মহাকাব্যে শয়তান যেমন দুর্জয় বাসনা ও ঋজুতা প্রদর্শন করে, মধুসূদনও রাবণকে দিয়ে সে কাজ করিয়েছেন। ভাব-ভাষা ও শব্দ ব্যবহারে কবি বিদেশি ক্লাসিক রীতি আয়ত্ত করে তা বাংলায় ব্যবহার করেছেন। কাব্যের বিভিন্ন সর্গে বীরত্ব, অভিমান, আক্ষেপ ইত্যাদি
প্রকাশিত। কয়েকটি প্রধান চরিত্র : রাম, মেঘনাদ, রাবণ, সীতা, লক্ষ্মণ, সরমা, বিভীষণ, প্রমীলা ইত্যাদি।
মেঘনাদবধ কাব্যের ট্র্যাজেডি সৃজন হয়েছে নায়ক রাবণ চরিত্রকে অবলম্বন করে।
মহাকাব্যের ভাব ভাষা হবে ঐশ্বর্যবান এবং রাজসিক গুণবিশিষ্ট। মহাকাব্যের থাকবে বিশালতা ও ঔদার্য। অমৃততুল্য পরমরস সম্পন্ন মন্ত্রমুগ্ধ ছন্দে যে কাব্যের মধ্যে আনন্দ ও বিশালতার রসােত্তীর্ণ ঐক্য আর স্থাপত্যশৈলীর চরমােকর্ষ প্রােথিত, তাই মহাকাব্য।
জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অভীপ্সার ইতিহাস হচ্ছে মহাকাব্য। একটি যুগ বিধৃত করে তার পরিপূর্ণ উদঘাটন ঘটে মহাকাব্যে।
কাহিনিবিন্যাস ও চরিত্রসৃষ্টির দিক থেকে দেখা যায়, মাইকেল রামায়ণ কাহিনির মহৎ ও স্নিগ্ধ কবিত্বের ওপর হােমারের ইলিয়াড’ কাহিনির কঠিন ও দীপ্ত শৌর্যের রং ফলিয়ে নতুন কবিকল্পনার ফসল মেঘনাদবধ মহাকাব্য সৃষ্টি করেছেন। তবে মেঘনাদবধ কাব্যে বাঙালির ঐতিহ্য রক্ষিত। যেমন পরিকল্পনায় তেমনি চরিত্র সৃষ্টিতে মহাকাব্যের লক্ষ্মণাক্রান্ত। প্রত্যেকটি চরিত্র অনুভূতির ঐশ্বর্যে ঐশ্বর্যবান। এ কাব্যের ভাষায় ওজস্বিতা, গাম্ভীর্য ও বিস্তৃতির পরিচয় পাই। অপেক্ষাকৃত অপ্রচলিত গুরুগম্ভীর শব্দ ব্যবহারে ওজোগুণ সমৃদ্ধ হয়েছে এবং সংযুক্ত বহুল পদ প্রয়ােগে মহাকাব্যোচিত দীপ্তির সমাবেশ ঘটেছে। ওজোগুণে এ কাব্য অদ্বিতীয়, বাক্যবিন্যাসে অনুপম এবং রসব্যঞ্জনায় অপূর্ব।
মহাকাব্যের অন্যতম লক্ষণ উপমা বৈশিষ্ট্য। উপমা প্রয়ােগে কবি বিস্ময়কর রকমের নিপুণ। পুরা কাব্যটিই উপমার আকর। এ কাব্যের উপমায় উপমান ও উপমেয় এর সাদৃশ্য কেবল নয়, উপমানের বৈশিষ্ট্যকে কবি পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন। তার বেশিরভাগ ঐশ্বর্য, বৈচিত্র্য, ঐতিহ্য ও সূক্ষ্ম অনুভূতির পরিচয় দেয়। এ কাব্যের উপমা অতিশয় ঐতিহ্যসম্মত। কাব্যের সর্গে সর্গে বৈচিত্র্য, বীরত্বের পাশে কারুণ্য, মূল কাহিনির পাশে উপকাহিনি।
কাব্যোচিত ছন্দ, ভাষা, অলঙ্কার ও রসাদি গুণে মেঘনাদবধ কাব্য অনন্য। মধুসূদনের ব্যক্তিজীবন, কবিমানস ও যুগমানসে যে বিদ্রোহ বিদ্যমান ছিল মেঘনাদবধ কাব্যের ছন্দে ও ভাবে তার প্রকাশ ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- ‘মেঘনাদবধ কাব্যের কেবল ছন্দোবন্ধে ও রচনা প্রণালীতে নহে, তাহার ভিতরকার ভাব ও রসের মধ্যে একটা অপূর্ব পরিবর্তন দেখিতে পাই। এ পরিবর্তন আত্মবিস্মৃত নহে। ইহার মধ্যে একটা বিদ্রোহ আছে ... ।
মেঘনাদবধ কাব্যে মধুসূদন দত্তের প্রবল দেশ প্রেমের প্রকাশ ঘটেছে।
অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত এ কাব্যে সর্গ সংখ্যা ৯টি। এই মহাকাব্যের কাহিনীর উৎস সংস্কৃত মহাকাব্য রামায়ণ।
এটি একটি বীর রসের কাব্য। প্রধান চরিত্র - মেঘনাদ (ইন্দ্রজিৎ), প্রমীলা, রাবণ, বিভীষণ, বিভীষণের স্ত্রী সরমা প্রমুখ ।
মেঘনাদবধ কাব্যে-
মেঘনাদবধ কাব্যে সর্গসংখ্যা ৯ টি ।
সর্গগুলো হলো ঃ
প্রথম সর্গ - অভিষেক
দ্বিতীয় সর্গ - অস্ত্রলাভ
তৃতীয় সর্গ - সমাগম
চতুর্থ সর্গ - অশােক বন
পঞ্চম সর্গ - উদ্যোগ
ষষ্ঠ সর্গ - বধ
সপ্তম সর্গ - শক্তিনির্ভেদ
অষ্টম সর্গ- প্রেতপুরী
নবম সর্গ - সংস্ক্রিয়া ।
মেঘনাদবধ কাব্য: মডেল প্রশ্ন
প্র : তাঁর রচিত অমর মহাকাব্যের নাম কী?
উ : মেঘনাদবধ কাব্য (১৮৬১)।
প্র : মেঘনাদবধ কাব্যের কাহিনি কোন মহাকাব্য থেকে গৃহীত হয়েছে?
উ : সংস্কৃত মহাকাব্য রামায়ণ ।
প্র : মেঘনাদবধ কাব্যের কাহিনির বিস্তার কোন্ ঘটনা থেকে কোন ঘটনা পর্যন্ত?
উ : মেঘনাদবধ কাব্যে নয়টি সর্গে সম্পূর্ণ, কাহিনিবিস্তার- বীরাবাহুর নিধন সংবাদ মৃত্যু ও চিতারােহণ পর্যন্ত । এই মহাকাব্যে মােট তিনদিন ও দুরাত্রির ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
প্র : : মেঘনাদবধ কাব্যে মধুসূদন কোন কোন পাশ্চত্য কবি ও কাব্য থেকে ঋণ গ্রহণ করেন?
উ : মেঘনাদবধ কাব্য রচনায় মধুসূদন কবি ভার্জিলের ইনিড, দান্তের ডিভাইন কমেডি, হােমারের ইলিয়াড ও মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট থেকে বহু কাহিনিসূত্র ও চরিত্রাদর্শ অনুসরণ করেছিলেন ।
প্র : মেঘনাদবধে চরিত্র সৃষ্টিতে মধুসূদন পাশ্চাত্যের কোন কবির চরিত্রের খানিকটা প্রভাব স্বীকার করেছিলেন?
উ : চরিত্র সৃষ্টিতে মধুসূদন ইংরেজ কবি মিল্টনের প্যারাইডাস লস্ট-এর চরিত্রের আংশিক প্রভাব স্বীকার করেছিলেন ।
প্র : মেঘনাদবধ কাব্যের নরক বর্ণনায় মধুসূদন কোন বিদেশি কবির কোন কাব্যকে অনুসরণ করেছিলেন?
উ : মেঘনাদবধ কাব্যের নরক বর্ণনায় মধুসূদন কবি ভার্জিলের ইনিড এবং দান্তের Divine comedy-তে বর্ণিত নরকের চিত্র অনুসরণ করেছিলেন।
Be Connected with us: Facebook Page Or Join to Our Facebook Goup