হাসান আজিজুল হক (১৯৩৬) ছােটগল্প রচনায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ (১৯৬৭) গল্পগ্রন্থের মধ্য দিয়ে তিনি পরিণত শিল্পীরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। দেশ বিভাগের ফলে সৃষ্ট ব্যক্তিচরিত্রের নৈতিক স্খলন সাম্প্রদায়িকতা এবং সংশ্লিষ্ট কারণে সৃষ্ট চরম হতাশা ও দারিদ্র্য, উত্তেজক পরিস্থিতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে রচিত হয় আত্মজা ও একটি করবী গাছ, পরবাসী, সারাদুপুর, অন্তর্গত নিষাদ, মারী, উটপাখি, সুখের সন্ধানে, আমৃত্যু আজীবন এই আটটি গল্প ।
আত্মজা ও একটি করবী গাছ' গল্পে প্রতীকী শিল্প-কৌশল প্রয়ােগ করা হয়েছে। ইনাম, সুহাস আর ফেকু– এই তিন সহচরকে নিয়ে গল্পের শুরু। তাদের কথাবার্তায় জীবনধারণে বিচিত্র রূপ ফুটে ওঠে।
বেকার তিন সহচর নানা অপকর্মে জীবন কাটায়। রাতে তারা এক জায়গায় যায়। সেখানে শীতল হওয়ার হাতছানি আছে। এক বুড়াে তার স্ত্রী ও আত্মজা রুকু বাড়িতে থাকে। রুকুর দেহবিক্রি করার টাকায় বুড়াের দিন কাটে। বুড়াে তাতে সহযােগিতা করে সত্য, কিন্তু করবী গাছের বিষফল খেয়ে জীবনের অবসানও কামনা করে।
‘পরবাসী’ বা ‘মারী’ গল্পতেও উঠে এসেছে দাঙ্গার উন্মত্ততা বা উদ্বাস্তু জীবনের ছবি। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ভিটেহারা রামশরণদের কথায় আমরা খুঁজে পাই বাস্তাহারার বেদনা -
উদ্বাস্তু জীবন সমস্যা মুক্তিযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতেও বদলায় না—উদ্বাস্তু বা দাঙ্গাতাড়িত জীবনের যে বিষন্নতা, সংকট রামশরণ যেন তাকেই একবার মনে করিয়ে দেয়।
দাঙ্গার নিজস্ব রাজনীতিতে ‘পরবাসী’ গল্পটি স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে। এভাবে সরাসরি দাঙ্গার কথা তিনি আর কোথাও বলেননি। যে গল্পে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে ধ্বংস হয় মানুষের মানবিক সত্তা, মানুষ কিভাবে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। সেদিন বশিরের মতাে প্রতিহিংসাপরায়ণ মানুষ কোমল বাংলাদেশকে হিংস্র করে তুলেছিল। শান্তি, সহাবস্থানের নিজস্বতাকে ভুলে এক মরণ খেলায় মেতে উঠেছিল মানুষ সেদিন—আর সেদিনই ‘ধর্ম তার ধারণ করার শক্তি হারায়। দাঙ্গার নিজস্ব রাজনীতিতে তাই ওয়াজুদ্দি চাচার মতাে স্থির প্রত্যয়ী মানুষদের খুন হতে হয় দাঙ্গাবাজদেরই হাতে।
‘পরবাসী’ গল্পটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমিকায় রচিত। বশির আর ওয়াজদ্দি পরের জমিতে চাষাবাদ করে। নিঃস্ব জীবন তাদের। কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তারা আপনজনদের হারায়। নির্মম দুর্ভোগের চিত্র হিসেবে গল্পটি বিবেচ্য ।
হাসান আজিজুল হকের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, হাসান আজিজুল হক বিশিষ্ট তার শিল্পসাধ্যের জন্য। আমাদের সমাজের নিচের তলার মানুষ কীভাবে মার খায়, মার খেয়ে মরতে মরতেও কীভাবে মাথা তােলে, সমাজ-সচেতন শিল্পীরূপে সেই জিনিসটি তিনি ব্যাপকভাবে তার গল্পে তুলে ধরেছেন।
তার গল্পে প্রক্রিয়ায় সংঘাত ও দ্বন্দ্বগুলি খুব-ই স্পষ্ট, কখনাে কখনাে ভয়ঙ্কররূপে পরিস্ফুট। কিন্তু ভাষা- শিল্পের প্রচণ্ড এক কাব্য সংঘাত সৃষ্টির মাধ্যমে এ ভয়ঙ্করের রূপ তিনি নির্মাণ করেন। তাতে জীবন যেমন ফুটে ওঠে, তেমনি জীবন চাপা পড়ে যায়। বৈশাখের পুঞ্জমেঘের কালাে সন্ধ্যায় মেঘের গর্জন যেমন বৃষ্টি আনে, আবার বৃষ্টিকে তাড়িয়েও দেয়, অনেকটা সেই রকম। বাংলাদেশের বাংলা ছােটগল্পের ধারায় এ গল্পগ্রন্থটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা, বিষয়বিন্যাস ও শিল্পরীতির অনন্য প্রকাশ ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পগ্রন্থটি।
Be Connected with us: Facebook Page Or Join to Our Facebook Goup