বাংলা গদ্যের অবয়ব নির্মাণে এবং বিবর্তনের ইতিহাসে প্যারীচাঁদ মিত্র ওরফে টেকচাঁদ ঠাকুরের নাম সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। সাহিত্যের ক্ষেত্রে তার অবদানও বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। তিনি কৌতুকরস- সঞ্চিত গল্পকাহিনি, নীতিমার্গীয় আখ্যান এবং আধ্যাত্মিক রূপক উপন্যাস রচনা করার মাধ্যমে সাহিত্যক্ষেত্রে স্বীয় কৃতিত্ব রেখে গেছেন।
প্যারীচাদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলাল’ পুস্তকাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে। নকশা জাতীয় এই গ্রন্থের কাহিনির ধারাবাহিকতা রক্ষা করে একটি পরিবারের উত্থানপতন দেখাতে গিয়ে তকালীন কলকাতার জীবনযাত্রার বিচিত্র বৈশিষ্ট্য বিদ্যাশিক্ষা, বিচার-আচার, ব্যবসা- বাণিজ্য, মােসাহেবপরিবৃত ঐশ্বর্যশালী ব্যক্তির আড়ম্বরপূর্ণ বিলাসবহুল জীবনালেখ্য অঙ্কিত হয়েছে।
সাধারণত উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য হিসেবে কাহিনি, চরিত্রচিত্রণ, মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, বাস্তবতা, সংলাপ, লেখকের জীবনদর্শন ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য।
আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থে লেখকের শিক্ষাত্মক মনােভাবের প্রকাশ ঘটলেও তৎকালীন উপন্যাস সৃষ্টির ক্ষীণ প্রচেষ্টার মধ্যে এই গ্রন্থকে উপন্যাসের সর্বাধিক লক্ষণাক্রান্ত বলে বিবেচনা করা চলে। তবে এই গ্রন্থে উপন্যাসের লক্ষণানুযায়ী কাহিনির ধারাবাহিকতা অনুসৃত হলেও তাকে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস রূপে গণ্য করা চলে না।
ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পর্যায়ের প্লট, অবান্তর ঘটনায় আচ্ছন্ন মূলকাহিনি, নায়কের অপরিণত ভূমিকা, অবহেলিত নারীচরিত্র, প্রণয়রসহীনতা প্রভৃতি ত্রুটির জন্য আলালের ঘরের দুলালকে প্রথম সার্থক উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায় না। বরং তৎকালীন জীবনধারার যথার্থ দর্শনে এবং কৌতুক বর্ণনায় উকৃষ্ট নকশাকার হিসেবেই প্যারীচাঁদ মিত্রের প্রতিষ্ঠা।
‘আলালের ঘরের দুলাল' উপন্যাসে তল্কালীন কলকাতার একশ্রেণির বিলাসী মানুষের চিত্রাঙ্কন করতে গিয়ে প্যারীচাঁদ মিত্র ব্যঙ্গবিদ্রুপের আশ্রয় নিয়েছিলেন। কাহিনির উৎপত্তি, বিকাশ ও পরিণতি প্রধান চরিত্র মতিলালকে অবলম্বন করে রূপায়িত হয়েছে। বাবুরামবাবু, ঠকচাচা, বাঞ্ছারাম ইত্যাদি চরিত্র টাইপ জাতীয় হলেও তাতে ব্যক্তিবৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। প্যারীচাঁদ মিত্রের যা কিছু সাফল্য তা আলালের ঘরের দুলাল’-এর বদৌলতেই, সমাজচিত্র হলেও লেখকের উদার নীতিবােধের কারণে এ গ্রন্থটির স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট রেখায় চিহ্নিত।
Be Connected with us: Facebook Page Or Join to Our Facebook Goup