শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘গৃহদাহ' (১৯২০) একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। শরৎচন্দ্রের সৃষ্ট সাহিত্যে ‘গৃহদাহ’র একটি বিশিষ্ট স্থান রয়েছে।
সাধারণভাবে বস্তুবাদ ও আদর্শবাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তার উপন্যাসে একটি পরিচিত বিষয়। উপন্যাসটি মাসিক ভারতবর্ষে প্রকাশিত হয়।
মহিম ও সুরেশ দুই পুরুষের প্রতি অচলার আকর্ষণ-বিকর্ষণ এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় উপকরণ। বিবাহ-বহির্ভূত কথিত অসামাজিক প্রেমের কাহিনিটি নিপুণ ঘটনা সংস্থানে ও বর্ণনার মনস্তাত্ত্বিক সূক্ষ্মতার দ্বারা সমস্যায়িত হয়ে উঠেছে। যে উপন্যাসগুলােতে শরৎচন্দ্রের অভিনবত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে তার মধ্যে ‘গৃহদাহ’ অন্যতম।
কল্লোল ও কল্লোল-উত্তর ঔপন্যাসিকদের দিক পরিবর্তনের প্রতীক হয়ে দেখা দিয়েছিল উপন্যাসটি। নিগূঢ় মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস ‘গৃহদাহ’ শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের গুণসমন্বিত।
নারী মনস্তত্ত্ব, নারী মনের প্রেমবাসনা, গৃহবাসনা, তার ত্যাগ-তিতিক্ষা শরৎচন্দ্রের অধিকাংশ উপন্যাসের বিষয়বস্তু। গৃহদাহের অচলা শরচ্চন্দ্ৰীয় নারীর গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে এসেছে। শুধু বিবাহিত নারীর অন্য পুরুষের আসক্তি নয়, অন্য পুরুষকে নিয়ে সারাজীবন চলার বাসনা, দুপুরুষের আকাঙ্ক্ষার সম্পূর্ণতা তাকে স্বাতন্ত্র দান করেছে।
যে ইচ্ছে কোনাে কোনাে নারীর জীবনে সত্য, অথচ প্রকাশের সুযােগ বা সাহস নেই, সেই সুযােগ ও সাহস দুই-ই তৈরি করে নিয়েছে এক নারী তার একক সামর্থ্যে। এক পুরুষ একাধিক নারী নিয়ে ঘর করে, সেটা না পারলেও অচলা দুই পুরুষকে ভালােবাসতে সমর্থ হয়েছে। এর কাহিনি, মূল মনস্তত্ত্ব, নারী স্বভাব, ঘটনা পরিবেশ, একের পর এক আছড়ে পড়া ঘটনার প্রবাহ সচকিত করে দেয়ার বিষয়টি আগন্তুক।
আকস্মিকতার ফলে উপন্যাসটি নাটকীয়তাপ্রাপ্ত হয়েছে। উপন্যাসটির পরতে পরতে অপেক্ষা করে আছে বিস্ময়। যেমন- ব্রাহ্ম বিদ্বেষী সুরেশের ব্রাহ্ম অচলাদের বাড়ি যাওয়া, সেখানে খাওয়া। মহিমের হাতে অচলার আংটি পরানাে। অচলার দাম্পত্য জীবনে সুরেশের রাজপুরে যাওয়া, মহিমের ঘরে আগুন লাগা, বায়ু পরিবর্তনের সময় সুরেশকে সাথে নেয়া, মােগলসরাইতে অচলাকে নিয়ে সুরেশের নেমে পড়া, মৃত্যুর পূর্বে মহিমের কাছে সুরেশের দলিল হস্তান্তর।
আকস্মিকতার কারণে উপন্যাসে চমৎকারিত্বের সৃষ্টি হয়েছে। পর মুহূর্তে কী ঘটবে তা পূর্বে আদৌ আঁচ করা যায় না। ব্যক্তি বা পরিবেশের প্রভাবে কেন্দ্রীভূত বিষয় নতুন বাঁক নিয়েছে। স্তম্ভিত করে দেয়ার মত পরিবেশ, ফলে চরিত্রসমূহ পাক খেতে শুরু করে ঘটনার, পরিবেশের অভিঘাতে। খুব সূক্ষ্ম ও বিবেচনাপ্রসূত ছকের মাধ্যমে ঔপন্যাসিককে সৃজনকর্মে ব্যাপৃত থাকতে হয়েছে।
মূল কাহিনির সাথে উপকাহিনির মেলবন্ধন ঘটেছে অদৃশ্য সুতার টানে, ঘটনার আকস্মিকতার সাথে পরস্পর সংযােজিত হয়েছে অনিবার্যভাবেই। এ উপন্যাসে সুরেশ ও মহিম দুই চরিত্রকে নির্মাণ করা হয়েছে বিপরীতমুখী চরিত্র হিসেবে। আবার মৃণাল ও অচলা দুই মেরুর দুই নারী চরিত্র। উপন্যাসের পরিণতি বিষয়ে যতই সন্দেহ থাকুক, সমগ্র উপন্যাসের কায়া গঠনে দুর্লভ কৃতিত্বের পরিচয় যে লেখক দিয়েছেন তাতে সন্দেহ নেই। গৃহদাহ বিষয়টি ঘটনাসূত্রে এসেও তা প্রতীকী তাৎপর্যমণ্ডিত।
গতিসম্পন্ন সরল গদ্য ভাষা নির্মাণে শরৎচন্দ্র যে অনন্য, তা তার বড় শত্রুও স্বীকার করবেন। এই সহজতা গঠন সৌকর্ষের পরিপন্থী, কিন্তু সরলকথা সরল পদ্ধতিতে বলার মধ্যে যে অহংকার আছে, সে গুণে ঋদ্ধ শরশ্চন্দ্র। অচলার জটিল মনােজগৎ, সুরেশের আবেগ আধিক্য, উচ্ছ্বাস বাহুল্য, সংযমহীনতা, মহিমের স্বল্পবাক প্রভৃতি চরিত্রানুগ ভাষা ব্যবহার করার সাথে সাথে প্রয়ােজনীয় পরিবেশ নির্মাণে তার শব্দের খেলা মনােরম ও চমঙ্কারিত্বের দাবিদার। কাহিনি-উপকাহিনির বিন্যাস, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, ভিন্নমুখী চারিত্রিক মুখিনতা, ভাষা প্রতিবেশ প্রভৃতি বিষয় বিবেচনায় শরৎচন্দ্রের ‘গৃহদাহ' শরৎ সাহিত্যের অনবদ্য সৃষ্টি।
Be Connected with us: Facebook Page Or Join to Our Facebook Goup