বিভাগ-পূর্ববর্তী পূর্ববাংলার দারিদ্র্য-বিধ্বস্ত পরিবারের চিত্র রূপায়িত হয়েছে শওকত ওসমানের জননী’ (১৯৬১) উপন্যাসে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশবিভাগ পর্যন্ত সময় পরিসরে উপন্যাসটি রচিত হলেও সমসাময়িক জীবনের পরিবর্তে ঔপন্যাসিক রূপদান করেছেন প্রায় বিশ বছর পূর্ববর্তী পশ্চিম-বাংলার গ্রামজীবনকে।
মহেশডাঙ্গা গ্রামের দারিদ্র-পীড়িত কয়েকটি পরিবারের বিশেষ করে উপন্যাসের নায়িকা দরিয়া বিবির পরিবারের নির্মম বাস্তবতাকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চিত্রিত করেছেন ঔপন্যাসিক।
গ্রামীণ সমাজের পরিবারে অসহায় নারী কিভাবে লােভী পুরুষের লালসার শিকার হয় সেদিকটিও উন্মোচিত হয়েছে এ-উপন্যাসে। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত আজহারের মৃত্যু হলে সংসারের দুরবস্থায় কঠোর বাস্তবের মুখে অসহায় দরিয়া মােনাদিরকে লেখাপড়ার খরচ চালানাের জন্যে অনন্যোপায় হয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও শরণাপন্ন হয় আজহারের ফুফাতাে ভাই ব্যবসায়ী ইয়াকুবের। উচ্ছ্বসিত ইয়াকুব প্রয়ােজনের বেশি টাকাই তাকে দেয়। এরপর মুখােশ উন্মোচিত হয় ইয়াকুবের। তার উপর দরিয়ার অব্যাহত নির্ভরতার সুযােগ নেয় সে।
গ্রামীণ মুসলিম পরিবারে লােকবিশ্বাস এবং কুসংস্কারের বিভিন্ন দিকও চিত্রিত হয়েছে এ-উপন্যাসে। প্রিয় সাদা বাছুর খুঁজতে আমজাদ পুরনাে কবরস্থানের কাছে গেলে সে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে এই আশংকায় দরিয়াবিবি তাকে বড় পীরের ‘পানি-পড়া’ এনে খাওয়ায়। কেন না অসুখ-বিসুখে লােকের কাছে পীরের মাজার একমাত্র আশ্রয়। আশেকজান দাদির মৃত্যুর পর নাতি আমজাদ রাতে দাদির স্বপ্ন দেখে ভয় পেলে তাকে খাওয়ানাে হয় মকতবের মৌলবীর কাছ থেকে ফু দেওয়া পড়া-পানি।
মুসলিম পরিবারে বহুবিবাহের চিত্রটিও মূর্ত হয়েছে এ-উপন্যাসে। ইয়াকুবের সংসারে দুই স্ত্রী বর্তমান। সংসারে প্রায়শ ঝগড়া লেগে থাকে। প্রতিবেশী ও দ্বিতীয় স্ত্রীর আত্মীয়রা বাধা দেয়ায় আরাে একটি বিয়ের চেষ্টা তার ব্যর্থ হয়। সংসারে পত্নীদের দ্বন্দ্বে ইয়াকুবের জীবন কতটা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিল তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার মহেশডাঙ্গা ত্যাগ করার প্রাক্কালে।
সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক সংগ্রাম, ধর্মান্ধতা ও গ্রামীণ দারিদ্র্যের কষাঘাত প্রতিফিলিত হয়েছে জননী উপন্যাসে। দরিয়াবিবি, হাসুবৌয়ের সন্তানাকাঙ্ক্ষা ও মাতৃময়ীরূপ, আজহারের শ্রমজীবন ও ধর্মান্ধতা, ইয়াকুবের গ্রাম্য উঠতি ধনীর প্রতিনিধিত্ব ও বহুবিবাহের লাম্পট্য জননী' উপন্যাসের গতিবিস্তার করেছে সমাজচিত্র রূপায়ণের মাধ্যমে।
শওকত ওসমান এখানে পরিমিত অপরিহার্য শব্দ চয়নে অসামান্য শিল্প-সংযমের স্বাক্ষর রেখেছেন। তার ঔপন্যাসিক দক্ষতায় দরিয়াবিবির নিস্পাপ নির্মল মূর্তিতে কোথাও কালির আঁচড় পড়েনি বিন্দুমাত্র।
পুরুষশাসিত সমাজ তথা পরিবারে ধর্মীয় পরিমণ্ডলে সম্পদ লােলুপতার ফলে নারী কিভাবে হয় বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার তার অমানবিক, স্বার্থপর ও নগ্ন রূপটি মূর্ত হয়েছে এ-উপন্যাসে।
Be Connected with us: Facebook Page Or Join to Our Facebook Goup