পশ্চাৎপদ সমাজের অচলায়তন ভেঙে সাহসী পদক্ষেপে অভ্যাসগত অদ্বৈত মল্লবর্মণ বাংলা কথাসাহিত্যে আজ উজ্জ্বল একটি নাম। তার কালজয়ী ' তিতাস একটি নদীর নাম' (১৯৫৬) উপন্যাস ভাগ্যবিড়ম্বিত দুস্থ মানুষদের জীবনালেখ্য।
তিতাস নদীর বিক্ষিপ্ত ঢেউ তীরবর্তী মানুষের জীবনে বয়ে আনে যে দোলাচল, তারই যথার্থ শিল্পী তিনি। তার এ উপন্যাসটি কেবল জীবনচিত্র নয়, সফল শিল্পকর্ম হিসেবেও স্বীকৃত।
এ উপন্যাসে চরিত্র, কাহিনি, ভাষা, প্লট এক অভিনব শিল্পমানে উত্তীর্ণ। এ উপন্যাসে তিতাস কেবল একটি স্রোতময় নদী নয়, তিতাস এ অঞ্চলের মানুষের সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্যের প্রতীক।
মালােদের জীবন- প্রবাহ এ নদীর প্রবাহের সাথেই জড়িয়ে আছে। এ নদী ছাড়া তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ নদীতে তাদের কেউ মাছ ধরে, কেউ মাঝিগিরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। আবার তিতাস যখন মাছশূন্য হয়ে পড়ে, তখনও তিতাসের শূন্য বুকে নৌকা ঠেলে দূর-দূরান্তে কাজের সন্ধানে যায় ।
‘তিতাস একটি নদীর নাম বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ একটি উপন্যাস। মহৎ শিল্পের সকল বৈশিষ্ট্য এ উপন্যাসে বিদ্যমান। এ উপন্যাস পাঠে মনে হয়, বিয়ােগান্তক রূপকথার নায়ক রাজপুত কিশাের, দুখিনী রাজকন্যা বাসন্তী। জীবন যাদের দিয়েছে সামান্য, নিয়েছে অনেক। যাদের জীবন ও জীবিকা তিতাস নামক নদীটিকে আশ্রয় করে। তিতাস হাসলে যারা হাসে এবং তিতাস কাঁদলে যারা নিঃশেষ হয়ে পড়ে।
উপন্যাসের কাহিনির বুনন বাস্তবতা চমৎকার। উপন্যাসের চরিত্রগুলাে লেখক যেন মনের মাধুরী মিশিয়ে তুলির আঁচড়ে এঁকেছেন। প্রবাসে যাত্রার পথে কিশােরের সৌন্দর্য-চেতনা, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি চরিত্রটিকে ভিন্নতা দিয়েছে। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির টানাপােড়নে চরিত্রটি ধীরে ধীরে ফুলের মতাে ফুটে উঠেছে। বাসন্তী চরিত্র আর এক শাশ্বত সৃষ্টি। যে পুরাে উপন্যাসের স্বাক্ষী। অনন্ত চরিত্র কিশােরের পরিপূরক। এছাড়া কালাের মা, উদয়তারা, নয়নতারা, বনমালী, সাধু, কাদির মিয়া ছােট বড় সব চরিত্রই নিজস্বতায় আলাদা।
উপন্যাসের অভ্যন্তরীণ জীবনদর্শন, তিতাস একটি নদীর নাম’কে আঞ্চলিক সীমা অতিক্রম করে। বিশ্বজনীনতার পথে নিয়ে গেছে। তিতাসের তীরবর্তী জেলে সম্প্রদায় মানুষদের জীবন তিতাসের উপর। নির্ভরশীল। তাদের জীবনে অভাব-দারিদ্র গাছের বাকলের মতাে। দুমুঠো অন্নের জন্য তাদের নিত্য সংগ্রাম। অথচ তার নিশ্চয়তা নেই। জীবন-মৃত্যুর ভয়াবহ সন্ধিতে তাদের অবস্থান।
ঔপন্যাসিক
অভ্যন্তরীণ শক্তি ধরা পড়ে যখন বাসন্তী প্রসঙ্গে ঔপন্যাসিক লেখেন-
চরিত্র, কাহিনিচিত্র ও ঘটনাসমূহ যথাযথ বিকাশের জন্য উপযােগী ভাষা নির্মাণ করেন। এ উপন্যাসের
অসামান্য কাব্যিক ভাব-ব্যঞ্জনায় ভাষা হয়ে উঠেছে শিল্প-উৎকর্ষমন্ডিত। কাহিনি, চরিত্রকে করেছে
যথার্থ বিকশিত।
মানব সত্তার জয়-পরাজয় এ ভাষায় রূপলাভ করেছে সফলভাবে। এ ভাষার অনন্তর মা যখন সূতা কাটিতে বসে, বৈশাখের উদাস হাওয়া তখন সামনের গাছ-গাছালি হইতে শুকনা পাত ঝরাইয়া লইয়া তার ঘরে ঢােকে। ... অনন্তর মার বুকের শূন্যতাটুকু তখন বেশি করিয়া তার নিজের কাছে প্রকাশ হইয়া পড়ে।
শিল্প সার্থক-মহৎ একটি রচনাই একজন লেখকের জন্য যথেষ্ট। একটি সার্থক শিল্পকর্মই স্রষ্টাকে চির স্মরণীয় করতে রাখতে পারে। তিতাস একটি নদীর নাম’ অদ্বৈত মল্লবর্মণকে সেই প্রান্তে নিয়ে গেছে। এ উপন্যাসে লেখকের জীবনাভূতি ও জীবন দর্শন অপরূপ কাহিনির মাধ্যমে যে রূপলাভ করেছে, তা যথার্থ শিল্পমান সম্মত।
Be Connected with us: Facebook Page Or Join to Our Facebook Goup