ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সর্বাধিক জনপ্রিয় এবং একাধিক বিদেশি ভাষায় অনূদিত উপন্যাস ‘পদ্মানদীর মাঝি’ (১৯৩৬)। তার ১৯টি উপন্যাসের মধ্যে পদ্মানদীর মাঝি শ্রেষ্ঠ। ভারতের বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষা ছাড়াও হাঙ্গেরীয়, রুশ, লিথুনিয়ান, চেক, নরওয়েজিয়ান ও সুইডিশ ভাষায় এবং ১৯৪৮ সালে 'Boatman of the Padma' নামে ইংরেজিতে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
পদ্মানদী আর কেতুপুর গ্রামের জেলে-মাঝিদের বাস্তবজীবন ব্যবস্থার বিষয়কে কেন্দ্র করে উপন্যাসের কাহিনি গড়ে উঠেছে।
ঘনবসতি জেলেপাড়ার মাঝি ও জেলেদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, অভাব- অভিযােগ নিপুণতার সাথে চিত্রিত হয়েছে।
তিন জেলে ধনঞ্জয়, কুবের ও গনেশ বর্ষার মৌসুমে সারারাত মাছ ধরে। প্রাকৃতিক দুযাের্গকে উপেক্ষা করে জীবন বাজি রেখে জীবিকা নির্বাহের নিমিত্তে তারা কাজ করে। ধনঞ্জয়ের নৌকা ও জাল কুবের ও গনেশ গতর খাটে। তাদের প্রাত্যহিক কাজ মাছ ধরা। সে মাছ দেবীগঞ্জে বিক্রি করে, যা পরে চালান হয় কলকাতায়। কুবের ও গণেশ যা মাছ পায় তা চার ভাগ হয়। নৌকা ও জালের মালিক হিসেবে ধনঞ্জয়ের দুই ভাগ অপরদিকে কুবের ও গনেশ পায় এক ভাগ করে।
পদ্মাপাড়ে কেতুপুরের বাসিন্দারা মাছ ধরা ছাড়াও মাঝিগিরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। যেমন শম্ভু, বগা আরাে অনেকে। অপরদিকে জেলেরাও পদ্মানদীর মাঝি তারা পদ্মা নদীতে নৌকা চালিয়ে মাছ ধরে। ভাগ্যের নির্মমতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তারা বংশপরম্পরায় জীবন ধারণ করে আসছে। পদ্মাপাড়ের কেতুপুর গ্রামের বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবন কাহিনি নিয়েই বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় এ আঞ্চলিক উপন্যাসটি রচিত।
উপন্যাসের আঙ্গিক গঠন, রচনাশৈলী, পাত্র-পাত্রীদের মুখে আরােপিত ভাষা, জীবনাচরণ, সংস্কৃতি- এসবই আঞ্চলিক উপপরিচয়বাহী। বাংলাদেশের আঞ্চলিক উপন্যাসগুলাের মধ্যে পদ্মানদীর মাঝি একটি সার্থক উপন্যাস।
সার্বিক বিচারে এ উপন্যাসটিকে সফল আঞ্চলিক উপন্যাসের পরিচয়বাহী বলা যেতে পারে। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গ সাহিত্য উপন্যাসের ধারা গ্রন্থে বলেছেন- ইহার একটি কারণ অবশ্য বিষয়ের অভিনবত্ব পদ্মানদীর মাঝিদের দুঃসাহসিক ও কতকটা অসাধারণ জীবনযাত্রারও আকর্ষণীয় শক্তি। দ্বিতীয় কারণ, পূর্ববঙ্গের সরস ও কৃত্রিমতা বিবর্জিত কথ্য ভাষার সুষ্ঠু প্রয়ােগ।
কিন্তু উপন্যাসটির সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ হইতেছে ইহা সম্পূর্ণরূপে নিম্নশ্রেণি অধ্যুষিত গ্রাম্যজীবনের চিত্রাঙ্কনে সূক্ষ্ম ও নিখুঁত পরিমিতিবােধ, ইহার সংকীর্ণ পরিধির মধ্যে সনাতন মানব প্রকৃতিগুলির ক্ষুদ্র সংঘাত ও মৃদু উচ্ছ্বাসের যথাযথ সীমা নির্দেশ।
পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসটি যে অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষতা ও শ্রেণি চেতনার প্রকাশ তা বাংলা সাহিত্যে বিরল। হােসেন মিয়া চরিত্রটিকে তার স্বকীয়তা প্রকাশ করেছেন। উপন্যাসটিতে পূর্ববঙ্গের সর্বহারা জেলেদের জীবনালেখ্য চিত্রিত হয়েছে এবং সেই শ্রেণির মানুষের মুখের ভাষাই ব্যবহৃত হয়েছে।
Be Connected with us: Facebook Page Or Join to Our Facebook Goup