নাগরিক মধ্যবিত্তের নগ্নতা, নৈতিকতাবর্জিত বিত্তসর্বস্বতা, রুচিবিকার ও হিংস্র কামনার চাপে বিপন্ন এক মেয়ের রক্তক্ষরণ ও হাহাকারের মধ্য দিয়ে একটি পরিবারের সার্বিক ভাঙনের চিত্র রূপায়িত হয়েছে শওকত আলীর পিঙ্গল আকাশ' (১৯৬৩) উপন্যাসে।
এ উপন্যাসের নায়িকা মঞ্জু মায়ের দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে আশ্রয় পায় সংসারের কাজে সাহায্যের জন্য। সেখানে বিকারগ্রস্ত পারিবারিক পরিস্থিতিতে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার মায়ের প্রেম মমতা-স্নেহের জগত থেকেও। এ সবই স্থান পেয়েছে মঞ্জুর ডায়েরির পাতায়।
এ এক আশ্চর্য বাড়ী। যেন শহরের হােটেল। পাশাপাশি থাকছে এরা, এক সঙ্গে বাস করছে। কিন্তু কেউ কারুকে চিনতে পারছে না, জানতে পারছে না।
মঞ্জুর চোখে ধরা পড়েছে, এই সংসারের প্রতিটি মানুষ আনিস, রাহুল, ছােট আপা প্রত্যেকেই এক ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তির অব্যক্ত যন্ত্রণায় দূরে সরে গেছে পরস্পরের কাছ থেকে। এক অদৃশ্য শক্তি যেন তাদের নিক্ষেপ করেছে বিনাশের স্রোতে।
মঞ্জুর বর্তমান বাবার পিতা বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে জমিদারী হারিয়েছেন। মঞ্জুর বাবা জমিজমার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে নেমেছিলেন ব্যবসায়। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। এক অদ্ভুত চরিত্র মঞ্জুর মায়ের মধ্যে মাতৃত্ব ও স্নেহের পরিবর্তে জেগে ওঠে বিকৃতি ও উন্মাদনা। বস্তুত সে-ই সংসারটিকে ঠেলে দেয় ধ্বংসস্রোতের আবর্তে, চূড়ান্ত সর্বনাশের দিকে। মঞ্জুর মধ্যে বিদ্রোহ থাকলেও নির্বিকার থাকতে হয় তাকে।
মঞ্জুর চোখের সামনে গােটা পরিবারটি তলিয়ে যেতে থাকে ধ্বংসের স্রোতে। অন্য পুরুষের সঙ্গে সালেহার সম্পর্কের কারণ আকস্মিক মৃত্যু ঘটে তার স্বামীর। মূলত সৎপিতার মৃত্যুর পরই শেকড়শূন্য হয়ে যায় মঞ্জু। এক নিরবলম্ব শূন্য জীবনে অবলম্বন প্রত্যাশায় সে মন প্রসারিত করেছিল আনিসের দিকে। কিন্তু এক সময় মঞ্জু অনুভব করেছে : 'সবাইতাে আমার এই রক্তমাংসের শরীরটার দিকেই হাত বাড়িয়েছে। আমার এই আঠারাে বছরের বয়সটাকে অভিশপ্ত করে তুলতে চেয়েছে। কাকে আমি শ্রদ্ধা করবাে, কাকে আমার ভালাে লাগবে।'
প্রকৃতপক্ষে মা সালেহার কারণেই মঞ্জুর নিক্ষিপ্ত হয়েছে গ্লানি ও ক্লেদপিচ্ছিলতার মধ্যে। কলঙ্কিত হয়েছে তার শুভ্র দেহ-মন, ধূসর, বিবর্ণ হয়ে গেছে তার বেঁচে থাকার স্বপ্ন। দুঃসহ বেদনায় সমগ্র বিশ্বসংসারের বিরুদ্ধে মঞ্জুর অভিযােগ : 'মা বাবাকে হত্যা করেছে আর আমাকে হত্যা করলাে এরা সবাই মিলে।'
বস্তুত মঞ্জুর এই যন্ত্রণা আর্থ-সামাজিক, পারিবারিক পরিস্থিতির অসঙ্গতিজাত। স্বগত যন্ত্রনায় নিজের মনের সঙ্গে বােঝাপড়া চলে মঞ্জুর।
এ-উপন্যাসে ব্যক্তির মনস্তত্ব ও জীবনজিজ্ঞাসা একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে রূপায়িত। কিন্তু এর ট্র্যাজেডির বীজ নিহিত রয়েছে শ্রেণিশােষণ-ধর্মশােষণ-জাতিশােষণপীড়িত সমাজের সার্বিক অব্যবস্থার মধ্যে।
বস্তুত এ-উপন্যাসে বিধৃত ট্র্যাজেডি কেবল মঞ্জুর নয়, বাংলাদেশের অসংখ্য অস্তিত্বকামী শুভ্রতা ও সুন্দরের প্রত্যাশী নারীর।
Be Connected with us: Facebook Page Or Join to Our Facebook Goup