বাংলা সাহিত্যে জীবনক্ষয়ী কথা সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯০৮-১৯৫৬) তৃতীয় উপন্যাস ‘পুতুল নাচের ইতিকথা (১৯৩৬)। তিনি ‘পদ্মানদীর মাঝি' উপন্যাসের লেখক হিসেবে পরিচিত হলেও ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এ উপন্যাসের কাহিনি বিশ্লেষিত। তবুও ভাববাদের মােহমুক্ত হতে পারেননি শিল্পী। তাই কুসুমের বাবা বলেছেন- সংসারের মানুষ চায় এক হয় আর, চিরকাল এমনি দেখে আসছি ডাক্তার বাবু। পুতুল বই তাে নই আমরা, একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছে। উপন্যাসের শেষপ্রান্তে এসেও আমরা তা লক্ষ্য করি ।
এই উপন্যাসে মানিকের পল্লীজীবনের বিশ্লেষণ হয়েছে নিপুণ এবং বাস্তব। পল্লীকে নিয়ে যারা লিখে খ্যাতি অর্জন করেছেন মানিক তার মধ্যে স্বতন্ত্র। মানিকের বর্ণনায় পল্লীজীবনের ভাব ও মাধুর্য প্রধান হয়ে ওঠে নি। দারিদ্র্য লাঞ্ছিত সাধারণ মানুষের বাস্তব জটিল জীবন অপূর্ব শিল্পরূপ লাভ করেছে।
মানিকের এ উপন্যাসে ধরা পড়েছে নতুন চেতনা, নতুন আঙ্গিক। মানুষ তার নিজের ইচ্ছাশক্তির নিয়ামক এই বিশ্বাস মানিক ভেঙ্গে দিয়েছেন। এই উপন্যাসেই মানিকের স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি শিল্পশৈলী এবং আগামী দিনের সম্ভাবনার ইঙ্গিতের পরিচয় পাওয়া যায় ।
আধুনিককালে ঈশ্বরে বিশ্বাস পর্যন্ত নেই, কিন্তু মৃত্যু অনস্বীকার্য। তাই উপন্যাসের শুরু হয়েছে মৃত্যু দিয়ে। মৃত্যু দিয়ে শুরু করে মানিক জীবনের কথা বলেছেন।
এ উপন্যাসে মানিকের সূক্ষ্ম বাস্তবধর্মিতার ভিত্তিতে চরিত্র সৃজন হয়েছে। প্রতিটি চরিত্র জীবন্ত এবং সার্থক। শশী এ উপন্যাসের সর্বশ্রেষ্ঠ চরিত্র। শশী পল্লী জীবনের নীরব দর্শক। মানিক শশীকে কেন্দ্র করে পল্লী মানুষের চিরায়ত জীবনধারা বর্ণনা করেছেন।
গােপাল, শশী, কুসুম, বিন্দু, সেনদিদি, যামিনী কবিরাজ, যাদব পণ্ডিত সব প্রধান অপ্রধান চরিত্রের ক্ষেত্রেই প্রযােজ্য। এরা কেউই নিজের জীবনকে নিজের অভিপ্রায় মত গড়ে তুলতে পারে নি। পুতুলের যেমন, মানুষের তেমনি নিজের ওপর কর্তৃত্ব নেই।
গোপালকে কাশীবাসী করেছে শশী, শশীর কলকাতা যাওয়ার পথ রুদ্ধ করেছে গােপাল। যাদবের মৃত্যুর জন্য দায়ী সে নিজেই। শশী কুসুমের সমস্ত প্রেমপূর্ণ উজ্জীবনকে ব্যর্থ করেছে, কুসুমও একদা অলীকে প্রত্যাখ্যাত করেছে। সুতরাং মানুষই পুতুল, আবার পুতুলের নিয়ন্ত্রক।
ধনতান্ত্রিক যুগে সমাজজীবন ও মানুষের সম্পর্ককে লেখক দেখেছেন অর্থের ভিত্তিতে। উপন্যাসের চরিত্রগুলােতে এসেছে দ্বৈততা। শশী গ্রামে নিবেদিত প্রাণ, আবার পাওনা নিয়ে কলহ করে। টাকার কঞ্জুস গােপাল; কিন্তু ছেলে যখন তার টাকা নিতে চায় না তখন সে বিমর্ষ। যাদব পণ্ডিত ইচ্ছামৃত্যু বেছে নেয়, কিন্তু অন্ধকার পথে সাপের ভয়ে সে লাঠি হাতে নেয়। কুসুমের মিথ্যে কথা বলতে ইচ্ছে করে। কাহিনির প্লট কিছুটা বৃত্তাকার। গাওদিয়া গ্রামে প্রবেশ পথে উপন্যাসের শুরু, সেই গ্রামের পরিক্রমায় কাহিনি শেষ ।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন : 'সাহিত্যিকেরও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা প্রয়ােজন। পুতুলনাচের ইতিকথায় সেই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়ােগ আছে। উপন্যাস আরম্ভ হয়েছে বজ্রাঘাতে নিহত হারু ঘােষের বর্ণনা দিয়ে। অন্যদিকে সেনদিদির সঙ্গে শশীর পিতা গােপালের সম্পর্ক, যাদব পণ্ডিত ও তার স্ত্রীর ইচ্ছামৃত্যু ইত্যাদি উপন্যাসটিকে বহুবিচিত্র করেছে। পুতুলনাচের ইতিকথা’য় পুতুল বলতে এই মানুষগুলােকেই বােঝানাে হয়েছে, যারা চারিত্রিক দৃঢ়তা নিয়ে দাঁড়াতে পারে না; পুতুলের মতাে অন্যের অল্প ধাক্কাতেই চালিত হয়।
কাহিনি, চরিত্র নির্মাণ, মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ মানিকের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসই কেবল নয়, বাংলা উপন্যাসের অন্যতম।
Be Connected with us: Facebook Page Or Join to Our Facebook Goup