কাব্য | কবিগণ |
---|---|
মনসামঙ্গল | কানা হরিদত্ত, নারায়ণ দেব, বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপিলাই, দ্বিজ বংশীদাস, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ |
চণ্ডীমঙ্গল | মানিকদত্ত, দ্বিজ মাধব, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, দ্বিজরাম দেব, মুক্তারাম সেন |
অন্নদামঙ্গল | ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর |
ধর্মমঙ্গল | ময়ূর ভট্ট, আদি রূপরাম, খেলারাম চক্রবর্তী, শ্যাম পণ্ডিত, ঘনরাম চক্রবর্তী, নরসিংহ বসু |
মঙ্গল শব্দের আভিধানিক অর্থ কল্যাণ। মধ্যযুগে বিভিন্ন লৌকিক দেবদেবীর মহিমা ও মাহাত্ম্যকীর্তন এবং পৃথিবীতে তাদের পূজা প্রতিষ্ঠার কাহিনি নিয়ে যেসব কাব্য রচিত হয়েছে, সেগুলােই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মঙ্গলকাব্য নামে পরিচিত।
কারাে কারাে মতে, দেবতাদের কাছে মঙ্গল কামনা করে এ কাব্যগুলাে রচিত হয়েছিল বলেই এগুলাের নাম মঙ্গলকাব্য।
মঙ্গলকাব্যসমূহের বিষয়বস্তু মূলত ধর্মবিষয়ক আখ্যান। মঙ্গলকাব্য পঞ্চদশ শতকের শেষভাগ থেকে অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে রচিত হয়েছিল।
পৌরাণিক, লৌকিক ও পৌরাণিক-লৌকিক সংমিশ্রিত দেবদেবীর লীলামাহাত্ম্য, পূজা প্রচার ও ভক্তকাহিনি প্রভৃতি অবলম্বনে রচিত সম্প্রদায়গত প্রচারধর্মী ও আখ্যানমূলক কাব্য হলাে মঙ্গলকাব্য।
বিভিন্ন দেবদেবীর গুণগান এবং পূজা প্রতিষ্ঠার কাহিনি মঙ্গলকাব্যের উপজীব্য।
বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযােগ্য মঙ্গলকাব্যগুলাে হচ্ছে মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল ইত্যাদি।
বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাসে মনসামঙ্গল সম্বন্ধেই প্রাচীনতম অস্তিত্বের প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়। এ কাব্যের কাহিনি বাংলার আদিম লােকসমাজে প্রচলিত সর্পপূজার ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত।
সাপের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসা। লৌকিক ভয়ভীতি থেকেই এ দেবীর উদ্ভব। তার অপর নাম কেতকা ও পদ্মাবতী। এ দেবীর কাহিনি নিয়ে রচিত কাব্য মনসামঙ্গল নামে পরিচিত। কোথাও তা পদ্মপুরাণ নামেও অভিহিত হয়েছে।
চাঁদ সওদাগরের বিদ্রোহ ও বেহুলার সতীত্ব নিয়ে রচিত কাহিনির জন্য মনসামঙ্গল সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। চাঁদ সওদাগর, বেহুলা মনসামঙ্গলের বিখ্যাত চরিত্র।
কানা হরিদত্তকে মনসামঙ্গলের আদিকবি হিসেবে মনে করা হয়। মনসামঙ্গলের দুই সেরা কবি বিজয়গুপ্ত এবং দ্বিজ বংশীদাস। বাংলা সাহিত্যে সুস্পষ্ট সন- তারিখযুক্ত মনসামঙ্গল কাব্যের প্রথম রচয়িতা বিজয় গুপ্ত। তার জন্ম বাংলাদেশের বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা গ্রামে।
এছাড়া মনসামঙ্গলের উল্লেখযােগ্য কবিরা হচ্ছেন বিপ্রদাস পিপিলাই, নারায়ণ দেব, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ প্রমুখ।
চণ্ডী দেবীর কাহিনি অবলম্বনে রচিত চণ্ডীমঙ্গল কাব্য এ দেশে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আদি কবি মানিক দত্ত। চণ্ডীমঙ্গলের শ্রেষ্ঠ কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। জমিদার রঘুনাথের সভাসদরূপে থাকাকালীন তার নির্দেশে মুকুন্দরাম চণ্ডীমঙ্গল কাব্য রচনা করেন। রঘুনাথ কবিপ্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে কবিকঙ্কণ’ উপাধি দেন। 'কালকেতু উপাখ্যান কবি মুকুন্দরামের সবচেয়ে জনপ্রিয় কাহিনিকাব্য।
প্রচলিত কাহিনি অবলম্বনে মুকুন্দরাম এ কাব্য রচনা করেন। চণ্ডীমঙ্গলের আদি কবি মানিকদত্তের কাব্য থেকে কিছু সাহায্য গ্রহণ করলেও কাব্য রূপায়ণে তার কৃতিত্ব অপরিসীম। তার কাব্যের বিষয়বস্তু পর্যালােচনা করলে দেখা যায় প্রথমে বন্দনা ও সৃষ্টিকাহিনি বর্ণিত হয়েছে, এরপর দেব খণ্ডে সতী ও পার্বতীর কাহিনি। দ্বিতীয় খণ্ডে আছে কালকেতুর কাহিনি এবং তৃতীয় খণ্ডের নাম বণিকখণ্ড যেমন রয়েছে ধনপতি সওদাগরের কাহিনি।
চণ্ডীমঙ্গলে কেবল দুটি কাহিনি পাওয়া যায়। অন্যান্য মঙ্গলকাব্যে একটিমাত্র কাহিনি রয়েছে। চণ্ডীমঙ্গলে ব্যাধের ওপর চণ্ডীর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে নিচু পর্যায়ে এবং বণিকের উপর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে অভিজাত শ্রেণীর মানুষের মধ্যে পূজা প্রচারের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।
চণ্ডীমঙ্গলের উল্লেখযােগ্য চরিত্র : কালকেতু, ফুল্লরা, ধনপতি, খুলনা, ভাড় দত্ত ও মুরারিশীল।
চণ্ডী ও অন্নদা অভিন্ন—একই দেবীর দুই নাম। অন্নদামঙ্গল ধারার শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্র রায়।
ভারতচন্দ্র মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ এবং শেষ কবি। মধ্যযুগের এ কবি ছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ভারতচন্দ্রকে উপাধি দিয়েছিলেন রায়গুণাকর।
ভারতচন্দ্রের রচিত একটি বিখ্যাত লাইন আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে'। উক্তিটি করেছিলেন ঈশ্বরী পাটনী (অন্নদামঙ্গল)।
তার কয়েকটি বিখ্যাত উক্তি :
১. নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়।
২. মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন।
৩. কড়িতে বাঘের দুধ মিলে।
৪. বড়র পিরীত বালির বাঁধ
ক্ষণে হাতে দড়ি ক্ষণেকে চাদ
ধর্মঠাকুর নামে কোনাে এক পুরুষ দেবতার পূজা হিন্দু সমাজের নিচু স্তরের লােকদের মধ্যে বিশেষত ডােম সমাজে প্রচলিত রয়েছে। ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম প্রচারের জন্য ধর্মমঙ্গল কাব্যধারার সূত্রপাত হয়েছে।
ধর্মমঙ্গল ধারার আদি কবি ময়ূর ভট্ট। ধর্মমঙ্গলের অন্যান্য কবিরা হচ্ছেন মানিকরাম, সীতারাম, ঘনরাম প্রমুখ ।
ধর্মমঙ্গল কাব্যের কাহিনি দুই ভাগে বিভক্ত—
১. লাউসেনের কাহিনি ও
২. রাজা হরিশ্চন্দ্রের কাহিনি।
এর মধ্যে লাউসেনের কাহিনিই এ কাব্যে প্রাধান্য পেয়েছে।
Be Connected with us: Facebook Page Or Join to Our Facebook Goup