প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাস ‘লালসালু’ (১৯৪৮)। তাকে বাংলাদেশের উপন্যাসে আজ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ ও যথার্থ উপন্যাস লেখক’ বিবেচনা করা হয়।
অস্তিত্বগ্রাসী ‘পশ্চাৎপদ গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক সাংস্কৃতিক কাঠামােলালিত জীবনের পটভূমিকায় নিরস্তিত্ব মজিদের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার নেতিবাচক রূপের অন্তর্ময় বিন্যাসে এ উপন্যাস হয়ে উঠেছে দেশ-বিভাগকালীন পূর্ববাংলার জীবন ও মনােবাস্তবতার ঔপন্যাসিক শিল্পরূপ। বস্তুত উপন্যাসটিতে উন্মোচিত হয়েছে মজিদের পরিবার সংকটের স্বরূপ।
মজিদ অস্তিত্বের অন্বেষণে প্রবেশ করে মহব্বতনগর গ্রামে এবং মােদাচ্ছের পীরের মাজার ব্যবসার মাধ্যমে তার উত্তরণ ঘটে সচ্ছলতায়। আধুনিক জীবনবাস্তবতা অঙ্গীকারের পরিবর্তে কর্মে ও বিশ্বাসে পশ্চাৎপদ, জীর্ণ ও নিশ্চল মধ্যযুগীয় অন্ধকারের মধ্যে বসবাসরত অস্তিত্ব বিষয়ে নিশ্চেতন মহব্বতনগর গ্রামের জনগােষ্ঠীর বিশ্বাস, সংস্কার এবং ধর্মভয়কে ব্যবহার করে মজিদ ক্রমান্বয়ে দৃঢ় করে নেয় তার স্বচ্ছলতাকে। এরপর সে বিয়ে করে রহিমাকে। পরবর্তীতে জীবনকে উপভােগ করার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় মজিদ দ্বিতীয়বার বিয়ে করে তরুণী জমিলাকে।
‘লালসালু' উপন্যাসে পুরুষশাসিত সমাজের পরিবারে নারীর অধিকারহীনতার এক বেদনাবহচিত্র মূর্ত হয়েছে জমিলার মধ্য দিয়ে। জমিলার জীবনের সমস্ত স্বপ্ন ও প্রত্যাশা ধূলিসাৎ হয়েছে মজিদের ভােগস্পৃহার বেদীমূলে। প্রথম থেকেই জমিলা তাই অন্তর থেকে গ্রহণ করতে পারেনি মজিদকে।
স্নেহকাতর জমিলা এক মাঝরাতের নির্মম নিঃসঙ্গতায় মজিদের পাশ থেকে লুকিয়ে চলে এসে আশ্রয়। নিয়েছিল রহিমার বুকে। আমরা প্রত্যক্ষ করি জমিলা প্রেমকাতর নয়, স্নেহ-বুভুক্ষু । গভীর রাতে জমিলাকে নিজের শয্যা পাশে না পেয়ে রহিমার বুকে ঘুমন্ত দেখে অতৃপ্তকাম মজিদ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে অসহনীয় ক্রোধে। বস্তুত মজিদের কাছে জমিলা ভালােবাসার পাত্রী নয়, ভােগের সামগ্রী স্বরূপ।
নিয়তির নির্মম পরিহাসে উচ্ছল কিশােরী জমিলা এক অমানবিক পরিবেশের শিকার, কৈশােরের বাধাবিহীন আনন্দঘন পরিবেশ থেকে তাকে বন্দি করা হয়েছে পুরুষশাসিত সমাজের সংসারের খাঁচায় । তার অপরিমেয় বেদনা তাই প্রথমে রূপ নেয় অভিমানে, পরে সে অভিমান গুমরে ওঠে অসহায় নীরব কান্নায়। শেষে জমিলা হয়ে ওঠে শব্দহীন অথচ বিদ্রোহের প্রতিমূর্তি।
'লালসালু' উপন্যাসে রয়েছে ধর্মব্যবসা, ধর্মান্ধতা, ধর্মের নামে শােষণ আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন অসহায় নরনারীর কাহিনি। ধর্মের ছদ্মাবরণে, ভণ্ডামির আশ্রয়ে মাজার ব্যবসায়ী মজিদের ধুরন্ধরতা ও প্রতারণার কৌশল ফুটে উঠেছে এ উপন্যাসে।
বদ্ধ সমাজের লালিত কুসংস্কার, শােষণ ও অত্যাচারের পটভূমিতে রূপায়িত এ উপন্যাস। ভণ্ডপীর মজিদকে উপেক্ষা করে আওয়ালপুরের পীর সাহেবের কাছ থেকে পানিপড়া আনতে যেয়ে পীর মজিদের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছিল। নারীর শাস্তির বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ করেছে রহিমা ও জমিলা। কিশােরী জমিলাকে বিয়ে করে তাকে মােকাবিলা করতে মজিদের ব্যর্থতা ও দৈন্য ফুটে উঠেছে এ উপন্যাসে।
লালসালু উপন্যাসের উল্লেখযােগ্য চরিত্র : মজিদ, খালেক ব্যাপারি, জমিলা, রহিমা, আমেনা, আক্কাস, তাহেরের বাপ, হাসুনির মা।
ঔপন্যাসিক ধর্মব্যবসায়ীদের উপলক্ষ করে লিখেছেন ; ‘খােদার এলেমে বুক ভরে না তলায় পেট শূন্য বলে। দার্শনিক চেতনাসমৃদ্ধ এ উপন্যাস ভাষার কারুকার্যে, দৃষ্টির তীক্ষ্ণতায়, আঙ্গিকের সুষ্ঠু রূপায়ণে ও পটভূমির বৈচিত্র্যে লেখকের নিরীক্ষাধর্মিতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
Be Connected with us: Facebook Page Or Join to Our Facebook Goup