গীতিকার ও সুরকার হিসেবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় স্বকীয়তার পরিচয় দিলেও নাট্যকার হিসেবে তার খ্যাতি কম নয়। ঐতিহাসিক, সামাজিক নাটক ও প্রহসন রচনার মাধ্যমে তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘সাজাহান’ (১৯০৯) ঐতিহাসিক নাটকটি শুধু তার সাহিত্যকীর্তির মধ্যে নয়, বাংলা নাট্যসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।
মােগল সম্রাট সাজাহানের ৩৮ বছরের রাজত্বকালের দ্বন্দ্বমুখরতা এবং জীবনের শেষ আট বছরের দ্বন্দ্ববহুল ঘটনাবলি এ নাটকের মৌল উপজীব্য। নাটকটি মঞ্চ সাফল্য ও জনপ্রিয়তার দিক থেকেও বাংলা নাটকের ইতিহাসে নাটকটি অসাধারণ মর্যাদা লাভ করেছে।
মােগল সিংহাসন নিয়ে ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব ও ষড়যন্ত্রের কুটিল জটিল পরিবেশ এবং এর বিষবাষ্প সমগ্র ভারতবর্ষে যে প্রভাব ফেলেছিল, সেই আলােড়ন ও ভ্রাতৃদ্বন্দের উত্তেজনা নাট্যকার দর্শকচিত্তে সঞ্চারিত করতে পেরেছেন। ইতিহাসের সত্যতার সাথে সাথে মানবহৃদয়ের শাশ্বত কিছু অনুভূতি নাট্যকার এ নাটকে উচ্চকিত করেছেন।
মােগল সম্রাট সাজাহানের রাজত্বকাল ৩৮ বছর (১৬২৭-১৬৬৫)। ১৬৫৭ সালে তাঁর রাজত্বের ৩০ বছর পূর্ণ হয়। এ বছরে ম্রাট দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে রাজ্য পরিচালনায় অসমর্থ হয়ে পড়েন। রাজ্যের প্রধান ব্যক্তিদের ডেকে জ্যেষ্ঠপুত্র দারাকে উত্তরাধিকারী হিসেবে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব দেন। দারা সম্রাটের নামে রাজকার্য পরিচালনা করেন। কিন্তু দারার এ ক্ষমতাপ্রাপ্তি সম্রাটের অন্য তিন পুত্র হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করে না। দাক্ষিণাত্য থেকে ঔরঙ্গজীব, গুজরাট থেকে মুরাদ, বাংলাদেশে সুজা দারার বিরুদ্ধে নড়তে চড়তে শুরু করে। মৃত্যু আসন্ন অনুমান করে সম্রাট দিল্লি ত্যাগ করে আগ্রায় আসেন। ঔরঙ্গজীবের ক্ষমতার লােভের কারণে দারাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়, অন্য ভাইয়েরা ঔরঙ্গজীবের হাতে বন্দি। সম্রাটও আগ্রায় বন্দিদশা পালন করেন। সম্রাটের শেষজীবনে এই নির্মম কাহিনি তথা সম্রাটের অসুস্থতার সুত্র ধরে চার পুত্রের মধ্যে রাজক্ষমতা দখলের হীন ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত এবং ম্রাটের উন্মাদগ্রস্ততা ও ঔরঙ্গজীবের বিজয়ই সাহাজান’ নাটকের কাহিনি।
শুধু ইতিহাসের তরঙ্গ বিক্ষোভ নয় বরং মানবিক অনুভূতির বিচিত্র চিত্র প্রকাশে সাজাহান’ নাটকে বিশেষ যুগের ইতিহাস বিকৃত হলেও চিরন্তন মানব-হৃদয়ের বাণী উচ্চারিত হয়েছে। সাজাহানের সম্রাটত্বের অন্তরালে পুত্রদ্বন্দ্বে কাতর পিতৃহৃদয়ের অসহায়ত্ব মানুষ সাজাহানকে প্রকাশ করেছে। ইতিহাসের ঔরঙ্গজীব যতটা নৃশংস ও অমানুষ, নাট্যকার তার চরিত্রে বিবেকের দ্বন্দ্ব, অনুতাপদগ্ধতা সৃষ্টি করে নাটকটিকে অনন্য করে তুলেছেন।
সংলাপের আড়ম্বর, বাকশৈলীর বর্ণাঢ্যতা, আবেগের প্রচণ্ডতা এবং ঘটনার অতি নাটকীয়তা এই নাটকের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সুললিত শব্দ, পরিপাট্য সুষম ছন্দমাধুর্য তার ভাষার গুণ। ইতিহাসের কাহিনি অনুসরণে নাট্যকার অত্যন্ত সাবধানতা ও সত্যনিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন।
Be Connected with us: Facebook Page Or Join to Our Facebook Goup