শব্দের মূল ধ্বনির যে সব পরিবর্তন ঘটে তাই ধ্বনি পরিবর্তন।
এর ফলে উচ্চারণের সময় এক ধ্বনির জায়গায় অন্য ধ্বনি আসে, পরের ধ্বনিকে আগেই উচ্চারণ করা
হয়, যুক্তাক্ষর ভেঙ্গে দেওয়া হয়, মূল শব্দে বাড়তি ধ্বনি আনা হয়, ধ্বনির ওলট-পালট ঘটে। সব ভাষাতেই এ ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ধ্বনি পরিবর্তনের ফলে নতুন শব্দ তৈরি হয়।
ধ্বনি পরিবর্তনে আছে বৈচিত্র্য, ভাষার গতিশীলতায় ও আধুনিকীকায়নে ধ্বনি পরিবর্তনের গুরুত্ব অনেক।
যেমন- সত্য > সত্যি, স্কুল > ইস্কুল, কপাট > কবাট ইত্যাদি।
ধ্বনির পরিবর্তন মানে শব্দের উচ্চারণ পরিবর্তন। মনে রাখতে হবে, ধ্বনি পরিবর্তনে কখনো অর্থের পরিবর্তন হবে না।
ধ্বনি পরিবর্তনের কারণ
আঞ্চলিকতা, দ্রুত কথা বলা, গুরুত্ব প্রদান, জিভের আলসেমি, অসাবধানতা, অনিচ্ছা, ত্রুটি, সহজে উচ্চারণ করার প্রবণতা ইত্যাদি কারণে ধ্বনির পরিবর্তন ঘটে।
স্বরধ্বনি এবং ব্যাঞ্জনধ্বনি উভয়ের ধ্বনি পরিবর্তন হয়ে থাকে।
ধ্বনি পরিবর্তনের প্রক্রিয়া প্রধানত তিন ভাবে হয়ে থাকে:
স্বরাগম
স্বরলোপ/সম্প্রকর্ষ
ধ্বনির রূপান্তর
স্বরাগম শব্দের মানে স্বর+আগম । উচ্চারণের সুবিধা বা অন্য কোন কারণে শব্দের আদি, মধ্য, অন্তে স্বরধ্বনির আগমন ঘটলে তাকে স্বরাগম বলে।
যেমন –
স্টেশন > ইস্টিশন, রাত > রাইত, আশ্ > আশা ইত্যাদি।
এই তিনটি উদাহরণ তিন রকম স্বরের আগমন দেখাচ্ছে ।
সুতরাং, স্বরাগম তিন প্রকার :
(ক) আদি স্বরাগম
(খ) মধ্য স্বরাগম বিপ্রকর্ষ/ স্বরভক্তি
(গ) অন্ত্য স্বরাগম
উচ্চারণের সুবিধার জন্য বা অন্য কোনাে কারণে শব্দের আদিতে /শুরুতে স্বরধ্বনি এলে তাকে আদি স্বরাগম(Prothesis)বলা হয়।
যেমন –
স্কুল > ইস্কুল
স্টেশন > ইস্টিশন
স্পৃহা> আম্পৃহা
স্ত্রী > ইস্ত্রি
স্তাবল > আস্তাবল
স্পর্ধা >আস্পর্ধা
উচ্চারণের সুবিধার জন্য সময় সময় সংযুক্ত ব্যঞ্জন ধ্বনির মাঝখানে স্বরধ্বনি আসে। একে বলা হয় মধ্য স্বরাগম বা বিপ্রকর্ষ বা স্বরভক্তি (Anaptyxis)।
সহজভাবে বলা যায়, চলিত ভাষায় সহজ করে উচ্চারণের জন্য সংযুক্তব্যঞ্জনকে ভেঙে তার মাঝে স্বরধ্বনি আনয়নের রীতিকে স্বরভক্তি বা বিপ্রকর্ষ বা মধ্যস্বরাগম বলে।
স্বরভক্তিতে অ, ই, উ, এ, ও স্বরধ্বনির আগম দেখা যায়।
যেমন :
স্বরধ্বনি | উদাহরণ |
---|---|
অ - | নির্জন > নিরজন রত্ন > রতন স্নেহ > ইস্নেহ শক্তি > শকতি মর্ম > মরম সূর্য > সুরুজ দর্শন > দরশন প্রাণ >পরান ধর্ম > ধরম হর্ষ > হরষ বর্ষিল > বরষিল স্বপ্ন > স্বপন জন্ম > জনম ভক্তি > ভকতি লগ্ন > লগন ইত্যাদি। |
ই - | প্রীতি > পিরীতি ক্লিপ > কিলিপ বর্ষণ > বরিষন ফিল্ম > ফিলিম ত্রিশ > তিরিশ ইত্যাদি। |
এ - | গ্রাম > গেরাম প্ৰেক > পেরেক স্রেফ > সেরেফ ইত্যাদি। |
উ - | মুক্তা > মুকুতা তুর্ক > তুরুক ভ্রু >ভুরু দুর্জন > দূুরুজন ধ্যান > ধেয়ান ব্যাকুল > বেয়াকুল প্রায় > পেরায় ঘ্রাণ > ঘেরান ব্ল্যাক > বেল্যাক শুক্রবার > শুক্কুরবার ইত্যাদি। |
ও - | চন্দ্র > চন্দোর শ্লোক > শােলােক মিত্র > মিত্তির মুরগ > মুরােগ > মােরগ কুর্ক > কোরােক ইত্যাদি। |
শব্দের শেষে কোনাে কোনাে সময় অতিরিক্ত স্বরধ্বনি আসে। এরূপ স্বরের আগমনকে অন্ত্যস্বরাগম বলা হয় ।
যেমন –
দিশ > দিশা
পােখ > পােক্ত
দুষ্ট > দুষ্টু
বেঞ্চ > বেঞ্চি
সত্য > সত্যি ইত্যাদি।
শব্দে ব্যঞ্জনের সংঙ্গে যদি ই ( আজি > আইজ ) বা উ (চালু > চাউল) যুক্ত থাকে এবং সেই ই বা উ নিজের জায়গায় উচ্চারিত না হয়ে উক্ত ব্যঞ্জনের আগে উচ্চারিত হয়, তাকে অপিনিহিতি বলে।
সহজ কথায়, যখন পরের ই-কার বা উ-কার আগে উচ্চারিত হয় তাকেই অপিনিহিতি বলে। ভাষাচার্য ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় Epenthesis শব্দের প্রতিরূপ ‘অপিনিহিতি বলে নির্দেশ করেছেন। ep-প্রতিরূপ ‘অপি’, ‘en'-এর প্রতিরূপ নি’, ‘thesis'-এর প্রতিরূপ ‘হিতি। অপিনিহিতি শব্দের অর্থ আগে স্থাপন ।
যেমন –
আজি > আইজ
রাখিয়া > রাইখ্যা
চলিয়া > চইল্যা
বাক্য > বাইক্য
কন্যা > কইন্যা
ভাসিয়া > ভাইস্যা
সত্য > সইত্য
কাব্য > কাইব্য
জালিয়া > জাইল্যা
চারি > চাইর
গদ্য > গইদ্য
রাতি > রাইত
মারি > মাইর
কাল > কাইল
আশু > আউশ
সাধু > সাউধ
গাছুয়া > গাউছ্যা
মাছুয়া > মাউছ্যা ইত্যাদি।
ক্ষ ও জ্ঞ-এর অন্তর্নিহিত ই-ধ্বনির অপিনিহিতি : সাক্ষাৎ > সাইকখাৎ, লক্ষ > লইকখ, বক্ষ > বইকখ ইত্যাদি।
অসমীকরণ (Dissimilation)হলো একই স্বরের পুনরাবৃত্তি দূর করার জন্য মাঝখানে স্বরধ্বনি যুক্ত করা।
যেমন –
ধপ + ধপ > ধপাধপ
পট + পট >পটাপট
গপ + গপ > গপাগপ
টপ + টপ > টপাটপ ইত্যাদি।
যদি একটি স্বরধ্বনির প্রভাবে শব্দে অপর স্বরের পরিবর্তন ঘটে তাকে স্বরসঙ্গতি বলে। শব্দে স্বরের মধ্যে অসম দূর করে সঙ্গতি বা মিল রক্ষা করার নামই স্বরসঙ্গতি।
যেমন –
ইচ্ছা > ইচ্ছে ( পূর্ববর্তী ই স্বরধ্বনির প্রভাবে পরবর্তী আ স্বরধ্বনি এ হয়েছে )
দেশি > দিশি
বিলাতি > বিলিতি
মুলা > মুলাে ইত্যাদি।
স্বরসঙ্গতি পাঁচ প্রকারের হয়ে থাকে:
(ক) প্রগত (Progressive) আদিস্বর অনুযায়ী অন্ত্যস্বরের পরিবর্তন । অর্থাৎ পূর্ববর্তী স্বরের প্রভাবে পরবর্তী স্বরের পরিবর্তন তথা পূর্ববর্তী স্বরের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা।
যেমন -
মুলা > মুলো ।
শিকা > শিকে।
তুলা > তুলো ইত্যাদি।
প্রগত স্বরসঙ্গতির নিয়ম:
✔ পূর্ববর্তী উচ্চাবস্থিত ই-স্বরের প্রভাবে পরবর্তী নিম্নাবস্থিত আ-স্বর উচ্চ-মধ্যাবস্থিত এ-স্বরে পরিণত হয়।
(ই — আ > এ) : মিথ্যা > মিথ্যে, মিঠা > মিঠে, ফিতা > ফিতে, বিলাত > বিলেত, ছিলাম > ছিলেম ইত্যাদি।
✔ পূর্ববর্তী উচ্চাবস্থিত উ (ক্ষেত্র বিশেষে ঊ)-স্বরের প্রভাবে নিম্নাবস্থিত আ-স্বর উচ্চ-মধ্যাবস্থিত ও-স্বরে পরিণত হয়।
(উ → আ > ও) : খুড়া > খুড়াে, জুতা > জুতাে, বুড়া > বুড়াে, রুপা > রুপাে, পূজা > পুজো, কুমড়া > কুমড়াে, ফুটা > ফুটো, ফুলা > ফুলাে ইত্যাদি।
✔ পূর্ববর্তী উচ্চাবস্থিত উ-স্বরের প্রভাবে নিম্নবথিত আ-স্বরের উচ্চাবস্থিত উ-স্বরে রূপান্তর ঘটে
(উ → আ > উ) : উনান > উনুন, কুড়াল > কুড়ুল, উড়ানি > উড়ুনি, ধুনারি > ধুনুরি ইত্যাদি।
✔ পূর্ববর্তী উচ্চাবস্থিত উ-স্বরের প্রভাবে নিম্ন-মধ্যাবস্থিত অ-স্বরের উচ্চাবস্থিত উ-স্বরে রূপান্তর ঘটে।
(উ — অ > উ) : পুত্র > পুত্তুর, নমঃশূদ্র > নমশুদ্র ইত্যাদি।
✔ পূর্ববর্তী উচ্চাবস্থিত ই-স্বরের প্রভাবে নিম্নাবস্থিত আ-স্বর উচ্চাবস্থিত ই-স্বরে পরিণত হয়।
(ই → আ > ই) : ভিখারি > ভিখিরি, বিলাতি > বিলিতি, বিকাকিনা > বিকিকিনি ইত্যাদি।
✔ পূর্ববর্তী নিম্নবস্থিত আ নিম্ন-মধ্যাবস্থিত অ, উচ্চাবস্থিত ই কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে ঔ-এর প্রভাবে পরবর্তী নিম্নবস্থিত আ, নিম্ন-মধ্যাবস্থিত অ উচ্চ-মধ্যাবস্থিত ও-স্বরে পরিণত হয় ।
(অ → অ > ও) : গরম > গরােম, গরব > গরােব, অনল > অনােল, খবর > খবোর ইত্যাদি।
(আ + অ > ও) : কঁাদন > কঁদোন, কাগজ > কাগােজ, আসল > আসােল ইত্যাদি।
(ই → অ > ও) : বিষম > বিষােম, পিতল > পিতােল, নিয়ম > নিয়ােম ইত্যাদি।
(ঔ → আ > ও) : চৌকা > চৌকো, মৌজা > মৌজা, নৌকা > নৌকো ইত্যাদি।
(ঔ → অ > ও) : দৌলত > দৌলােত, সৌরভ > সৌরােভ ইত্যাদি।
(খ) পরাগত (Regressive) : অন্ত্যস্বরের কারণে আদ্যস্বরের পরিবর্তিত। অর্থাৎ পরবর্তী স্বরের প্রভাবে পূর্ববর্তী স্বরের পরিবর্তন তথা পরবর্তী স্বরের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা।
যেমন-
আখোয়া > আখুয়া > এখো।
দেশি > দিশি।
পরাগত স্বরসঙ্গতির নিয়ম:
✔ পরবর্তী নিম্নাবস্থিত আসরের প্রভাবে পূর্ববর্তী উচ্চাবস্থিত উ-স্বর উচ্চ-মধ্যাবথিত ও স্বরে পরিণত হয়।
(আ → উ ) ও) : বুনা > বােনা, খুদা > খােদা বুঝা > বােঝা, ভুলা > ভােলা, শুনা > শােনা, ফুলা> ফোলা ইত্যাদি।
✔ পরবর্তী নিম্ন-মধ্যাবস্থিত অ, নিম্নবথিত আ বা উচ্চ-মধ্যাবস্থিত এ-স্বরের প্রভাবে পূর্ববর্তী উচ্চাবস্থিত ই-স্বর উচ্চ-মধ্যাবস্থিত এ-স্বরে পরিণত হয়।
(অ, আ, এ → ই > এ) : শিখা > শেখা, শিখে > শেখে, লিখা > লেখা, লিখে > লেখে, মিলা > মেলা, ফিরা > ফেরা ইত্যাদি।
✔ পরবর্তী উচ্চাবস্থিত ই (ক্ষেত্রবিশেষে ঈ) স্বরের প্রভাবে পূর্ববর্তী নিম্নাবস্থিত আ-স্বর উচ্চাবস্থিত ই উচ্চ-মধ্যাবস্থিত এ-স্বর উচ্চাবস্থিত ই স্বরে পরিণত হয়।
(ই→ আ, এ> ই) : সন্ন্যাসী > সন্নিসি, বেটি > বিটি, দেশি > দিশি ইত্যাদি।
✔ পরবর্তী নিম্নাবস্থিত আ, উচ্চ-মধ্যাবস্থিত এ আর ও স্বরের প্রভাবে পূর্ববর্তী উচ্চ-মধ্যাবস্থিত এ স্বরের বিকৃত উচ্চারণ অ্যা হয় ।
(আ, এ, ও→ এ > অ্যা) : খেলা > খ্যালা, ঠেলা > ঠ্যালা, দেখে > দ্যাখে, গেল > গ্যালাে।
(গ) মধ্যগত (Mutual) : আদ্যস্বর ও অন্ত্যস্বর অনুযায়ী মধ্যস্বরের পরিবর্তন । অর্থাৎ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী স্বরের প্রভাবে মধ্যে অবস্থিত স্বর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী স্বরের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে।
আগের ও পরের ই স্বরের প্রভাবে মাঝের আসর ই-স্বরে পরিণত হয় : যেমন - বিলাতি > বিলিতি
এরকম-
ভিখারি > ভিখিরি, জিলাপি > জিলিপি ইত্যাদি।
(ঘ) অন্যোন্য স্বরসঙ্গতি (Reciprocal) : আদ্য ও অন্ত্য দুই স্বরই পরস্পর প্রভাবিত হয়। অর্থাৎ এখানে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী স্বর পরস্পরকে প্রভাবিত করে উভয়ে পরিবর্তিত হয়।
যেমন- মােজা > মুজো, ধোঁকা > খুঁকো, পােষ্য > পুষ্যি ইত্যাদি।
কিছু কিছু শব্দের স্বরসঙ্গতিতে একাধিক বার স্বরসঙ্গতিজনিত পরিবর্তন ঘটে।
যথা- হিসাবি > হিসেবি > হিসিবি, উড়ানি > উড়ােনি > উড়ুনি, বিলাতি > বিলেতি > বিলিতি ইত্যাদি।
(ঙ) চলিত বাংলায় স্বরসঙ্গতি :
গিলা > গেলা
মিলামিশা > মেলামেশা
মিঠা > মিঠে
ইচ্ছা > ইচ্ছে ইত্যাদি।
পূর্বস্বর উ-কার হলে পরবর্তী স্বর আ-কার হয় না, ও-কার হয়।
যেমন –
মুড়া > মুড়ো।
চুলা > চুলো ইত্যাদি।
বিশেষ নিয়মে –
উড়ুনি > উড়নি
এখনি > এখুনি হয়।
দ্রুত উচ্চারণের জন্য শব্দের আদি, অন্ত্য বা মধ্যবর্তী কোনো স্বরধ্বনির লোপ হয়।
যেমন –
বসতি > বস্তি
জানালা > জান্লা ইত্যাদি।
(ক) আদিস্বরলোপ (Aphesis) :
যেমন—
উদ্ধার > উধার > ধার
অলাবু > লাবু > লাউ
(খ) মধ্যস্বর লোপ (Syncope) :
অগুরু > অগু
সুবর্ণ > স্বর্ণ
গামোছা > গামছা
(গ) অন্ত্যস্বর লোপ(Apocope):
আশা > আশ্
আজি > আজ
চারি > চার (বাংলা)
সন্ধ্যা > সঞঝা >সাঁঝ
বন্যা > বান
চাকা > চাক
লজ্জা > লাজ
শব্দের মধ্যে দুটি ব্যঞ্জনের পরস্পর পরিবর্তন ঘটে।
যেমন –
ইংরেজি বাক্স > বাংলা বাস্ক
জাপানি রিক্সা > বাংলা রিস্কা ইত্যাদি
অনুরুপ -
তলোয়ার > তরোয়াল
পিশাচ > পিচাশ
লাফ > ফাল।
লোকসান > লোসকান
মগজ > মজগ
ডেস্ক > ডেকস
শব্দমধ্যস্থ দুটি ভিন্ন ধ্বনি একে অপরের প্রভাবে অল্প-বিস্তর সমতা লাভ করে।
যেমন –
জন্ম > জম্ম
কাঁদনা > কান্না
বিল্ব > বিল্ল
গল্প > গল্প
কুৎসিত > কুচ্ছিত ইত্যাদি।
সমীভবন তিনভাবে হয়:
(ক) প্রগত সমীভবন
(খ) পরাগত সমীভবন
(গ) অন্যোন্য সমীভবন
প্রকৃতপক্ষে সমীভবন স্বরসঙ্গতিরই মতাে ব্যঞ্জনসঙ্গতি। সেজন্য সমীভবনকে ব্যঞ্জনসঙ্গতিও বলা হয়।
(ক) প্রগত (Progressive) সমীভবন : প্রগত সমীভবনে পূর্ব ধ্বনির প্রভাবে পরবর্তী ধ্বনির পরিবর্তন ঘটে ।
যেমন –
পদ্ম > পদ্দ
চক্র > চক্ক
গলদা > গল্লা
পক্ব > পক্ক
চন্দন > চন্নন
স্বর্ণ > সন্ন
রাজ্য > রাজ্জ
পদ্ম > পদ্দ
লগ্ন > লগগ ইত্যাদি।
(খ) পরাগত (Regressive) সমীভবন : পরবর্তী ধ্বনির প্রভাবে পূর্ববর্তী ধ্বনির পরিবর্তন হয়।
যেমন-
তৎ + জন্য > তজ্জন্য
তৎ + হিত > তদ্ধিত
কর্ম > কম্ম
কর্তা > কত্তা
যতদূর > যদ্দুর
সর্প > সম্প
করতাল > কত্তাল
উৎ + মুখ > উন্মুখ (উচ্চারণ- উম্মুখ)
ধর্ম > ধম্ম
পাঁচসের > পাঁশসের
ডাকঘর > ডাগঘর
বিপদ + জনক > বিপজ্জনক ইত্যাদি।
(গ) অন্যোন্য (Mutual) সমীভবন : পরস্পরের প্রভাবে দুটো ধ্বনিই পরিবর্তিত হয় ।
যেমন—
সংস্কৃত সত্য > প্রাকৃত সচ্চ
সংস্কৃত বিদ্যা > প্রাকৃত বিজ্জা ইত্যাদি।
দুটো সমবর্ণের একটির পরিবর্তন ঘটে। সমীভবনের বিপরীত রীতি বিষমীভবন। বিষমীভবনের ব্যবহার লেখ্য ভাষায় বিরল। প্রধানত মৌখিকে ব্যবহৃত হয়।
যেমন –
শরীর > শরীল
লাঙ্গাল > নাঙ্গল
লেবু > নেবু
তরবার > তরােয়াল
লাল > নাল ইত্যাদি।
কখনাে কখনাে জোর দেয়ার জন্য শব্দের অন্তর্গত ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব উচ্চারণ হয়, আর এটাই দ্বিত্ত্ব ব্যঞ্জন (Long Consonant) বা ব্যঞ্জনদ্বিত্বা :
যেমন –
পাকা > পাক্কা
মুলুক >মুল্লুক
বড় > বড্ড
ছোট > ছোট্ট
সকাল > সক্কাল
কিছু > কিচ্ছু ইত্যাদি।
শব্দ-মধ্যে কোনো কোনো সময় কোনো ব্যঞ্জন পরিবর্তিত হয়ে নতুন ব্যঞ্জনধ্বনি ব্যবহৃত হয়।
যেমন -
কবাট > কপাট
ধোবা > ধোপা
শাক > শাগ
ধাইমা > দাইমা ইত্যাদি।
পাশাপাশি সমউচ্চারণের দুটি ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে তার একটি লোপ পায়। এরূপ লোপকে ধ্বনিচ্যুতি বা ব্যঞ্জনচ্যুতি বলা হয়।
যেমন–
বউদিদি > বউদি
বড় দাদা > বড়দা ইত্যাদি।
ব্যঞ্জনধ্বনি লোপ পায়।
যেমন-
ফাল্গুন > ফাগুন
ফলাহার > ফলার
আলাহিদা > আলাদা ইত্যাদি।
বিপর্যস্ত স্বরধ্বনি পূর্ববর্তী স্বরধ্বনির সাথে মিলে গেলে এবং তদনুসারে পরবর্তী স্বরধ্বনির পরিবর্তন ঘটলে তাকে অভিশ্রুতি বলা হয় ।
যেমন –
করিয়া থেকে অপিনিহিতির ফলে ‘কইরিয়া
কিংবা বিপর্যয়ের ফলে ‘কইরা’ থেকে অভিশ্রুতিজাত করে।
এরূপ –
শুনিয়া > শুনে
বলিয়া > বলে
হাটুয়া > হাউটা > হেটো
মাছুয়া > মেছো ইত্যাদি।
আধুনিক চলিত বাংলায় অনেক ক্ষেত্রে র-কার লোপ পায় এবং পরবর্তী ব্যঞ্জন দ্বিত্ব হয়।
যেমন –
তর্ক > তক্ক
করতে > কত্তে
মারল > মাল্ল
করলাম > কল্লাম।
আধুনিক চলিত ভাষায় অনেক সময় দুই ঘরের মাঝামাঝি হ-কারের লোপ হয়।
যেমন—
পুরোহিত >পুরুত
গাহিল > গাইল
চাহে > চায়
সাধু > সাহু > সাউ
আরবি আল্লাহ্ > বাংলা আল্লা
ফারসি শাহ্ > বাংলা শা ইত্যাদি।
য়-শ্রুতি ও ব-শ্রুতি (Euphonic glides) : শব্দের মধ্যে পাশাপাশি দুটো স্বরধ্বনি থাকলে যদি এ দুটো স্বর মিলে একটি দ্বি-স্বর (যৌগিক স্বর) না হয়, তবে এ স্বর দুটোর মধ্যে উচ্চারণের সুবিধার জন্য একটি ব্যঞ্জনধ্বনির মতাে অন্তঃথ ‘য়’ (Y) বা অন্তঃস্থ ‘ব’ (W) উচ্চারিত হয়।
এই অপ্রধান ব্যঞ্জনধ্বনিটিকে বলা হয় য়-শ্রুতি ও ব-শ্রুতি ।
যেমন – মা + আমার = মা (য়) আমার > মায়ামার।
যা + আ = যা (ও) য়া = যাওয়া।
এরূপ – নাওয়া, খাওয়া, দেওয়া ইত্যাদি।
নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনি ঙ (ং), ঞ, ণ, ন, ম লােপ পাওয়ার ফলে পূর্ববর্তী স্বরধ্বনি সানুনাসিক হলে, পরিবর্তনজনিত এই প্রক্রিয়ার নাম নাসিক্যীভবন।
নাসিক্যীভবনে সানুনাসিক স্বরধ্বনি নাসাপথে অনুরণিত হয়ে বহির্গত হয়।
ভণ্ড > ভাঁড়, গুম্ফ > গোঁফ, কঙ্কণ > কাঁকন, হংস > হাঁস ইত্যাদি নাসিক্যীভবনের উদাহরণ।
নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনির লুপ্তির ফলে পূর্ববর্তী স্বরের নাসিক্যীভবনের আরাে কিছু উদাহরণ :
১. ‘ঙ লােপের ফলে নাসিক্যীভবন : অঙ্ক > আঁক, কঙ্কণ > কাঁকন, কঙ্কর > কাঁকর, বঙ্ক > বাঁক, পঙ্ক > পাঁক, শঙখ > শাঁখ,ইত্যাদি।
ব্যতিক্রম: শৃঙ্খল » শিকল।
২. অনুস্বারযুক্ত নাসিক্য ব্যঞ্জনের নাসিক্যীভবনের প্রবণতা : হংস > হাঁস, বংশ > বাঁশ, দংশ > ডাঁশ, অংশু > আঁশ ইত্যাদি।
৩. ‘ঞ’ লােপের ফলে নাসিকীভবন : পঞ্জর > পাঁজর, পঞ্জিকা > পাঁজি, অঞ্চল > আঁচল, পঞ্চ > পাঁচ ইত্যাদি।
৪. ‘ণ’ লােপের ফলে নাসিক্যীভবন : কণ্টক > কাটা, ভণ্ড > ভাঁড়, ষণ্ড > ষাঁড় , দণ্ড > দাঁড়, চণ্ডাল > চাঁড়াল।
৫. ‘ন’ লােপের ফলে নাসিক্যীভবন : চন্দ্র > চাঁদ, সন্ধ্যা > সাঁঝ, বদ্ধ > বাঁধ, ফন্দি > ফাঁদ, দন্ত > দাঁত, ক্রন্দন > কঁাদন, বন্ধন > বাঁধন, স্কন্ধ > কাঁধ ইত্যাদি।
৬. ‘ম’ লােপের ফলে নাসিক্যীভবন ; গুম্ফ > গোঁফ, চম্পক > চাঁপা, কল্প > কাঁপা , তাম্বু > তাঁবু ইত্যাদি।
৭. বাস্তব ধ্বনির অনুকরণে সৃষ্ট কিছু কিছু ধ্বন্যাত্মক শব্দের উচ্চারণে নাসিক্যীভবন : ঝাঁ ঝাঁ, চোঁ চেঁা, ভোঁ ভোঁ, শোঁ শোঁ, খাঁ খাঁ, বোঁ বোঁ ইত্যাদি।
৮. নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনি ছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বরধ্বনি সানুনাসিক হয়। এই প্রবণতাকে বলা হয়
স্বতঃস্ফূর্ত বা স্বতােনাসিক্যীভবন।
যেমন- হাসি > হাঁসি , আখ > আঁখ, পুথি > পুঁথি, সূচ > সূচ, আচ > আঁচ, পেচা > পেঁচা/প্যাঁচা ইত্যাদি।
৯. সম্মানসূচক সর্বনাম পদে স্বতােনাসিকীভবনের প্রয়ােগ দেখা যায়। যথা— যাঁহারা > যাঁরা, তাহাঁর > তাঁর, > যাঁহার > যাঁর ইত্যাদি
১০. বিদেশি শব্দের বাংলা উচ্চারণে স্বতােনাসিক্যীভবন : হুক-ক > হুঁকা, পিয়াজ > পিঁয়াজ, পাপায়া > পেপে > পেঁপে, হসপিটাল > হাসপাতাল > হাঁসপাতাল ইত্যাদি।
১১. রাঢ়ি ও ঝাড়খণ্ডি উপভাষায় কিছু কিছু শব্দে স্বভােনাসিক্যীভবনের ঝোঁক দেখা যায়। যেমন- বাসা > বাঁসা,
সাজ > সাঁজ , খােকা > খোঁকা, কুকুর > কুঁকুর ইত্যাদি।
১২. স্বতোনাসিক্যীভবনের ফলে কিছু কিছু শব্দের অর্থ—পার্থক্যও ঘটে।
যেমন-
- কাটা = ছেদন বা কর্তন করা, কাঁটা= কণ্টক
- খাই= খাওয়া(উত্তম পুরুষ), খাাঁই= লােভ
- পাশ = দড়ি বা রজ্জু , পাঁশ = ভস্ম বা ছাই
- দাঁড়ি = পূর্ণচ্ছেদ, দাড়ি = শ্মশ্রু
- পাজি = বদমাস, পাঁজি = পঞ্জিকা
- সাজ = পােশাক = পরিচ্ছদ, সাঁজ/সাঁঝ = সন্ধ্যা
- টাক = কেশহীন মস্তক , টাঁক = লক্ষ্য, তাক
- ভাজ = ভাইয়ের স্ত্রী, ভাঁজ = পাট, মােড়া
আমরা অনেক সময় অঘােষধ্বনিকে ঘােষধ্বনি করে নিই, আবার ঘােষধ্বনিকে অঘােষ করি, তেমনি অল্পপ্রাণ ধ্বনিকে করি মহাপ্রাণ বা মহাপ্রাণ ধ্বনিকে করি অল্পপ্রাণ।
অঘােষধ্বনিকে ঘােষধ্বনি : এরূপ পরিবর্তনকে ঘােষীভবন (Voicing) বলে ।
উদাহরণ- কাক > কাগ
ঘােষধ্বনিকে অঘােষ : এরূপ পরিবর্তনকে অঘােষীভবন (De-voicing) বলে ।
উদাহরণ- গুলাব > গােলাপ
অল্পপ্রাণ ধ্বনিকে মহাপ্রাণ : এরূপ পরিবর্তনকে মহাপ্রাণীভবন (Aspiration) বলে ।
উদাহরণ- পাশ > ফাঁস
মহাপ্রাণ ধ্বনিকে অল্পপ্রাণ : এরূপ পরিবর্তনকে অল্পপ্রাণীভবন (De-aspiration) বলে ।
উদাহরণ- ভগিনী > বােন।
অপরিচিত শব্দ লােকমুখে পরিচিত শব্দের সাদৃশ্য পেয়ে যে পরিবর্তন ঘটে তাকে লােকনিরুক্তি বলে।
যেমন : উর্ণবাভ > উর্ণনাভ।
প্রচলিত কোনাে শব্দের সাদৃশ্য বা উক্তির প্রভাবে দেশি বা বিদেশি শব্দকে অনুরূপ করে উচ্চারণ করাকে লােক-ব্যুৎপত্তি বলে।
যেমন : Armchair > আরামকেদারা, Hospital > হাসপাতাল ইত্যাদি।
প্রশ্ন : কোন রীতিতে স্নান' শব্দটি সিনান (স্নান > সিনান) শব্দে পরিণত হয়?
উত্তর: স্বরাগম
প্রশ্ন: গ্রাম > গেরাম- এখানে কোনটি ঘটেছে?
উত্তর: স্বরাগম
প্রশ্ন: রত্ন > রতন হওয়ার ধ্বনিসূত্র-
উত্তর: স্বরভক্তি
প্রশ্ন: মধ্যস্বরাগমের সমার্থক কোনটি?
উত্তর: স্বরসঙ্গতি
প্রশ্ন: আশু > আউশ- এটি ধ্বনি পরিবর্তনের কোন নিয়মের উদাহরণ?
উত্তর: অপিনিহিতি
প্রশ্ন: দ্রুত উচ্চারণের জন্য শব্দের আদি, অন্ত বা মধ্যবর্তী কোনাে স্বরধ্বনি লােপ পেতে বলে?
উত্তর: সম্প্রকর্ষ
প্রশ্ন: পাশাপাশি সম উচ্চারণের দুটি ব্যঞ্জন ধ্বনি থাকলে তার একটি লোপ পায়—এরূপ লোপকে কী বলে?
উত্তর: ব্যঞ্জনচ্যুতি
প্রশ্ন: একটি স্বরধ্বনির প্রভাবে শব্দে অপর স্বরের পরিবর্তন ঘটলে তাকে কী বলে?
উত্তর: বিষমীভবন
প্রশ্ন: একই স্বরের পুনরাবৃত্তি দূর করার জন্য মাঝখানে স্বরধ্বনি যুক্ত হওয়াকে -
উত্তর: অসমীকরণ বলে
প্রশ্ন: অন্ত্যস্বর পরিবর্তিত হয় আদিস্বর অনুযায়ী কোন ধরনের স্বরসঙ্গতিতে?
উত্তর: প্রগত
প্রশ্ন: দুটি সমবর্ণের একটির পরিবর্তনকে কী বলে?
উত্তর: বিষমীভবন
Be Connected with us: Facebook Page Or Join to Our Facebook Goup