বাংলা নাটকের বিকাশ ও সমৃদ্ধিদানে মীর মশাররফ হােসেনের ভূমিকা অতুলনীয়।
মীর মশাররফ হােসেন বাংলা নাট্য সাহিত্যে এক অসামান্য শিল্প প্রতিভা।
তাঁর জমীদার দর্পণ’ (১৮৭৩) নাটকটি তৎকালীন সমাজ বাস্তবতার এক নিপুণ ছবি।
অত্যাচারী ও চরিত্রহীন জমিদার হায়ওয়ান আলীর অত্যাচার এবং অধীনস্থ প্রজা আবু মােল্লার গর্ভবতী স্ত্রী নূরন্নেহারকে ধর্ষণ ও হত্যার কাহিনি জমীদার দর্পণ (১৮৭৩)- এর মূল ঘটনা ।
তৎকালীন সমাজে জমীদারদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ধ্বংস হয়েছে শত শত কৃষক পরিবার।
এই নাটকে তেমন একটি কৃষক পরিবারের উপর জমীদারদের অত্যাচারের ভয়াবহ কাহিনি চিত্রিত হয়েছে।
জমীদার দর্পণ’নাটকের মূল কাহিনিকে নবনাট্যায়নে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
এ নাটকের প্রথম দৃশ্য থেকে চতুর্থ দৃশ্য পর্যন্ত প্রথম অঙ্ক।
এ দৃশ্যগুলাের মধ্যে আবু মােল্লার শান্ত ও গৃহগত জীবনে নানা সংকটের ইঙ্গিত দেখানাে হয়েছে।
পঞ্চম থেকে দশম দৃশ্য পর্যন্ত দ্বিতীয় অঙ্ক। এ পর্যায়ে আবু মােল্লার সংসার ও জীবনে চূড়ান্ত বিপর্যয় ঘটে যায়। এ অংশেই নাটকের কাহিনির চরম বিকাশ ঘটেছে।
একাদশ থেকে উনবিংশ দৃশ্য পর্যন্ত তৃতীয় অঙ্ক। এ অধ্যায় নাটকের পরিণতির অধ্যায়। এখানে ইংরেজ শাসনে দুবৃত্তায়ন ও আবু মােল্লার সার্বিক সর্বনাশ চিত্রিত হয়েছে।
মিথ্যা অপরাধে তার মৃত্যু এ অংশেই প্রকাশিত।
চরিত্র নাটকের গতিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, মূলত ঘটনার পারম্পর্য রক্ষার জন্যেই চরিত্রের সৃষ্টি।
জমীদার দর্পণ’ চরিত্রের বর্ণাঢ্য আয়ােজনে সমৃদ্ধ নাটক। চরিত্র চিত্রণে নাট্যকার যথেষ্ট সচেতন ছিলেন।
তাই নাটকে প্রতিটি চরিত্র ঘটনার প্রবাহমানতার আবর্তে বাঁধা। এর সাথে সম্পৃক্ত কোন চরিত্রই অপ্রয়ােজনীয় কিংবা বাহুল্য নয়।
জমিদার সিরাজ আলী ও মেরাজ আলী সমগ্র জমিদার তথা শােষক শ্রেণির যােগ্য প্রতিনিধি।
জমিদারদের অত্যাচার, নির্যাতন-শােষণ চিত্রণে এ চরিত্র দুটির উপস্থিতি অত্যন্ত বাস্তবানুগ ।
আবু মােল্লা ও ফজু মিয়া অসহায় দরিদ্র কৃষকের প্রতিরূপ।
জিতু মােল্লা ও হরিদাস বৈরাগী দুজনে ধূর্ত, লােভী, নিলজ্জ ও মিথ্যাবাদী। কৃষ্ণমণি অত্যন্ত ঘৃণ্য চরিত্র।
এর তিনজনেই জমিদারের পাপ কর্মের সহচর। দুই ব্যক্তিত্বহীন, তােষামােদে, পরগাছা চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়।
নুরন্নেহার এই নাটকের প্রকৃত বেদনাদীর্ণ এক দর্পণ। বাংলার সহজ-সরল, সিদ্ধ বধূ সে। আমিরন এক নিঃশব্দ রমণী।
নবনাট্যায়নে আমিরন বােবা ও বধির । দারােগা চরিত্রটি অতি সরস ও কৌতুকময়।
নাটক যেহেতু জীবনেরই চিত্ররূপ, তাই জীবনকে জীবনের সংকটকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করার শাশ্বত কাহিনি সংশ্লিষ্ট চরিত্রের রূপায়ণ অতি জরুরি।
আর এদিক বিবেচনায় ‘জমীদার দর্পণ অত্যন্ত সফল।
নাটকের কাহিনি খুব বেশি বিস্তৃত না হলেও মর্মান্তিক।
আবু মােল্লা নামক একজন দরিদ্র কৃষকের মুখে জমিদারের অত্যাচারের ইঙ্গিত দিয়ে এ নাটকে কাহিনির গতিময়তা লাভ করেছে।
এতে স্থান কাল ও সময়ের ঐক্য যথাযথভাবে পালিত হয়েছে।
মশাররফ হােসেন লিখেছেন, নাটকটির কিছুই সাজানাে নয়, অবিকল ছবি তুলে ধরা হয়েছে প্রচলিত সমাজের।
ওই সময় মুসলিমগণ বাংলা চর্চায় এগিয়ে এসেছে কমই। এই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন‘ পত্রিকায় নাটকটির প্রশংসা করে লিখেছেন, 'অনেক হিন্দুর প্রণীত বাঙ্গালার অপেক্ষা এই মুসলমান লেখকের বাঙ্গালা পরিশুদ্ধ'।
নামকরণে দীনবন্ধু মিত্রের নীল-দর্পণে’র প্রভাব যেমন প্রবল, নাটকটির ঘটনাবিন্যাসেও এর কম ছায়া পড়ে নি ।
Be Connected with us: Facebook Page Or Join to Our Facebook Goup