মধুসূদনের একটি উল্লেখযােগ্য ঐতিহাসিক নাটক ‘কৃষ্ণকুমারী’ (১৮৬১), যা বাংলা সাহিত্যের প্রথম
সার্থক ট্র্যাজেডি নাটক হিসেবে খ্যাত। ইতিহাসের কাহিনি অবলম্বনে লিখিত এটিই প্রথম বাংলা নাটক।
বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের সগৌরব আবির্ভাব ঘটেছিল নাট্যরচনার সূত্র ধরে। বাংলা নাটকের দীনহীন অবস্থা প্রত্যক্ষ করে তিনি নাটক রচনায় আত্মনিয়ােগ করেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে তার বিস্ময়কর প্রতিভা বৈচিত্র্যমুখী হয়ে ওঠে। বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক নাট্যকার হিসেবে মাইকেল
মধুসূদন দত্তের স্থান সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
শিল্পী উইলিয়াম টডের ‘রাজস্থান’ নামক গ্রন্থ হতে কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের কাহিনি গ্রহণ করে নাটকের প্রয়ােজনে ইতিহাসকে কিছুটা অন্য খাতে প্রবাহিত করলেও তিনি কোনাে ঘটনাকে বিকৃত বা পরিবর্তিত করেন নি। নাটকটিতে অনেক বেশি বিশ্বস্ততার সাথে ইতিহাসকে অনুসরণ করা হয়েছে।
নারীর প্রতি ধনলােভী কপট পুরুষের প্রতিহিংসা এবং তার ফলে নিরপরাধ তরুণীর আত্মাহুতি কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের মূল বিষয়।
চাটুকার ধনদাস স্বীয় স্বার্থ উদ্ধারের জন্য জয়পুরের রাজা
জগৎসিংহকে উদয়পুরের রাজকন্যা কৃষ্ণার চিত্রপট দেখিয়ে তাকে বিয়ের প্রস্তাবে প্রলুব্ধ করে। কিন্তু বিলাসবতীর সহচরী মদনিকা ধনদাসের দুরভিসন্ধি নস্যাৎ করে দিয়ে কৌশলে মানসিংহের প্রতি কৃষ্ণাকে অনুরাগী করে তােলে এবং কৃষ্ণার জবানিতে মদনিকা মানসিংহকে পত্র দিলে মানসিংহও কৃষ্ণাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। জগৎসিংহ ও মানসিংহ উভয়ের একই কথা কৃষ্ণাকে না পেলে উদয়পুর আক্রমণ করবে। কৃষ্ণা সবকিছু জানতে পেরে রাজ্যের কল্যাণের কথা ভেবে আত্মাহুতি দেয়।
শিল্পী এ নাটকে ইতিহাসের তথ্য অক্ষুন্ন রেখে একাধারে ভীমসিংহের ট্র্যাজিক পরিণতি, দেশ জাতির কল্যাণের জন্য কৃষ্ণার আত্মদানের অনুষঙ্গ টেনেছেন।
মেবারে পূর্ব গৌরব ও বর্তমান হীন অবস্থার সন্ধিস্থলে কাহিনি সংস্থাপিত করে শিল্পী অতীতের স্মৃতিমাত্র অবশিষ্ট, ভেদবুদ্ধিতে দুর্বল, স্বাধীনতা রক্ষায় অসমর্থ মেবারি জাতির প্রত্যাসন্ন পতন কাহিনি বেদনার ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন।
কৃষ্ণার কাহিনির আশ্রয়ে মেবারবাসীদের চরম দুর্ভাগ্যের চিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে শিল্পী স্বদেশিকতার সুরের সাথে কৃষ্ণার করুণ কাহিনির মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন বিশেষ পারঙ্গমতায় ।
ভীমসিংহের একদিকে একমাত্র আদরের কন্যা, অন্যদিকে রাজ্য রাজ্যের জনগণ। দুটোর উপরই দরদ ও কর্তব্য তার একই। মেয়ের জীবন রক্ষা করলে রাজ্য ধ্বংস হবে, রাজ্য রক্ষা করলে মেয়ের জীবন বিনাশ হবে। এ টান টান সংকট নাটকের দ্বন্দ্বকে সৃজনশীল করেছে।
মনিকাকে নিয়ে যে উপকাহিনি রচিত হয়েছে তার সাহায্যে রাজা ও ধনদাসের বৃত্তান্ত যুক্ত করে জটিলতা সৃষ্টি করেছে। শিল্পী উপকাহিনির মাধ্যমে মূল কাহিনিতে বর্ণিত উদয়পুরের রাজার আসন্ন দুর্যোগের আভাস দিয়েছেন।
জয়পুর হতে সৃষ্ট ঘটনার ধারা উদয়পুর অভিমুখে শােকাবহ পরিণামের বীজ বহন করে প্রবাহিত হল।
নারী রূপের প্রতি আকাঙ্ক্ষা, ধনলােভ, ঈর্ষা ও রাজমর্যাদা প্রতিষ্ঠার অহমিকা এই বিচিত্র প্রবৃত্তিসমূহকে একত্রিত করে বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে, মঞ্চ উপযােগী ঋদ্ধ সংলাপে এক স্রোতমুখী করে কাহিনিতে গতি সঞ্চার করা নাট্যকারের সার্থকতার বিশেষ মাত্রা।
কৃষ্ণকুমারী’ নাটক ঐতিহাসিক ও অনৈতিহাসিক উভয় প্রকার চরিত্রের সক্রিয়তায় গতিময়তা পেয়েছে।
ঐতিহাসিক চরিত্রগুলােতে যথেষ্ট ক্রটি রয়েছে- যেমন ভীমসিংহকে আরাে শক্তিমত্তাসম্পন্ন করা উচিত ছিল। সে বহুলাংশে নিষ্ক্রিয়। কৃষ্ণা রাজনীতি বিচ্ছিন্ন চরিত্র। তবুও রাজ্যের জন্য হঠাৎ জীবনদান কিছুটা বিসদৃশ। কিন্তু নাট্যকার ধনদাস ও মনিকা নামে যে দুটি অনৈতিহাসিক চরিত্র নির্মাণ করেছেন, তা শিল্পীর সর্বৈব পারঙ্গমতায় কালােত্তীর্ণ। মনিকার বুদ্ধি, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, দুঃসাহসিকতা ও রহস্যপ্রিয়তা তাকে বিশিষ্ট চরিত্রের মর্যাদায় আসীন করেছে।
নাটকের বিয়ােগান্ত পরিণতির জন্য কেউ যদি দায়ী থাকে তবে সে মনিকা। ধনদাস তেমনি ধূর্ত এবং মূলত ধনেরই দাস। তার অর্থলােলুপতার সূত্র ধরেই কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের মৌল কাহিনি গতিময়তা পেয়েছে। কৃষ্ণকুমারী নাটক বাংলা ঐতিহাসিক রােমান্টিক ট্র্যাজেডির পথপ্রদর্শক।
Be Connected with us: Facebook Page Or Join to Our Facebook Goup